কখনো ভ্যানে করে সবজি বিক্রি, আবার কখনো রিকশা চালিয়ে সংসারের ঘানি টানেন মিজানুর রহমান। এভাবে ৩০ বছর। তার ওপর সামাজিকভাবে মানুষের কটাক্ষ, চার মেয়ের বাবা বলে। অনেকেই বলত, মারা গেলে খাট ধরারও লোক নেই মিজানের। একদিন রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত শরীরে চায়ের দোকানে গল্প করছিলেন এক জেলের সঙ্গে। জেলে জানালেন, তার ছেলে পুলিশ সুপার হয়েছে। তখনই মিজানের মনে আশা জাগে, তার সন্তানও পারবে। এরপর থেকে চার মেয়ের লেখাপড়ায় জোর দেন তিনি।

গত মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) প্রকাশিত মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী মিজানুর রহমানের তৃতীয় মেয়ে সাদিয়া আফরিন হারিছা রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে হারিছা পেয়েছেন ৭৮। সব মিলিয়ে ৩০০ নম্বরের মধ্যে তার মোট নম্বর ২৭৮।

বরিশাল থেকে হারিছা যখন মোবাইলে এ খবর জানাচ্ছিলেন বাবা মিজানুর রহমান তখনো রিকশায় যাত্রী নিয়ে ছুটছিলেন। পরে বাড়িতে গিয়ে দেখেন সেখানে দুনিয়াজোড়া আনন্দ, এলাকাবাসী সবাই দেখতে আসছেন হারিছাকে।

বরিশালের বানারীপাড়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড-এর বিজয় সিংহ লেনের বাসিন্দা মিজানুর রহমানের জীবনে দারুণ খুশির উপলক্ষ এনে দিয়েছেন তার মেয়ে। মিজান বলেন, আমি এখন আর কোনোকিছুর অভাব বোধ করছি না। তবে টেনশনে আছি, মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর খরচ পাব কোথায় তা নিয়ে।

হারিছা বলেন, আমাদের প্রতিবেশীরা সবসময় আমার মাকে খোঁটা দিয়ে বলত, ‘চার মেয়ের মা, একটাও ছেলে জন্মাতে পারেনি।’ তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। এসব কটাক্ষ শুনে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, এমন কিছু হবো যেন পরিবারে ছেলের অভাব পূরণ করতে পারি।

ছোট বেলার একটা ঘটনা মনে করে হারিছা বলেন, একবার আমার মা গর্ভবতী অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে বরিশাল হাসপাতালে ৬ ঘণ্টা আইসিইউতে রাখতে হয়েছিল। ওই ৬ ঘণ্টায় ১৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। আরো ৬ ঘণ্টা রাখার দরকার ছিল, কিন্তু আমার আব্বার টাকা ছিল না বলে মাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। ঠিকভাবে চিকিৎসা না হওয়ায় মাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

পরিবারের এসব অভাব-অনটন দেখে ছোটকাল থেকেই লেখাপড়ায় ভালো করার চেষ্টা শুরু করেন হারিছা। ভালো ছাত্রী হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তাকে সহযোগিতা করেন।

তিনি বলেন, আমি রিকশাওয়ালার মেয়ে হলেও আমার মা-বাবা আমার অহংকার। তাদের নিয়ে আমি গর্ব করি। স্কুল-কলেজে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ৬৭টি পুরস্কার জিতেছি। এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য মাকে এসে বলতাম, মা আগামীকাল অমুক জায়গায় প্রতিযোগিতা আছে। মা কখনো কিছুতে না বলতেন না। রাতে আমার পোশাক ইস্ত্রি করে রাখতেন। সকালে উঠে বলতেন, চল।

হারিছা বলেন, আমার মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছেন ছোট চাচা আজিজুল হক। তিনি আমাকে বরিশাল কলেজে নিয়ে ভর্তি করিয়েছেন। লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন। এখন আমি চাই, একজন মানবিক ডাক্তার হতে। ডাক্তার নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে তারা রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। ঠিকভাবে চিকিৎসা দেন না। আমি ডাক্তার হলে যদি জানতে পারি কোনো রোগী গরিব, তার ভিজিট (ফি) তো রাখবই না বরং চিকিৎসার যত পরীক্ষা এবং ওষুধ লাগবে তা আমি বহন করব। কথা দিলাম।

হারিছার মা রাজিয়া বেগম কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, আমার খুব আনন্দ লাগছে, খুব খুশি লাগছে। ৬ মাস অনেক কষ্ট করেছি। আজ যখন সে চান্স পেয়েছে তখন সেই কষ্ট আর নেই। তবে এখন দুশ্চিন্তায় আছি। মেডিকেলে চান্স তো পেল, এখন রাজশাহী গিয়ে পড়ালেখা করার খরচ কীভাবে আসবে? আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমার মেয়েকে যেভাবে সকলে সহায়তা করে আজকের এ পর্যন্ত এনেছেন, সেভাবে যেন আমার মেয়েও গরিবদের সহায়তা করতে পারে।

সাদিয়া আফরিন হারিছার চাচা আজিজুল হক বলেন, আমি বরিশাল বিএম কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলাম। সেখানে ভালো স্কুলের শিক্ষার্থীদের যে ধরনের দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখেছি, আমার ভাতিজিরও পড়ালেখায় তেমন মেধা ও দক্ষতা ছিল। এজন্য হারিছাকে বরিশাল নিয়ে ভর্তি করাই। আজ সে আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আমার ইচ্ছা, তাকে বিদেশে পড়ার জন্য পাঠাব।

বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিপন কুমার সাহা বলেন, যারা উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী, তাদের পাশে সরকার সব সময় আছে। সাদিয়া আফরিন হারিছা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে শুনে আমরা আনন্দিত। তাদের আর্থিক কোনো সহায়তার দরকার হলে উপজেলা প্রশাসন থেকে তা করা হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এমএএস