ঘুষ ও তদবির ছাড়াই পুলিশে চাকরি! এমন কথা স্বপ্নেও ভাবেননি তারা। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তব হয়েছে। শনিবার (৯ এপ্রিল) রাতে কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর এ খুশিতে জয়পুরহাট পুলিশ লাইন্স ড্রিলশেডে কেঁদেছে সবাই। 

এসময় কনস্টেবল পদে এক মেয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর তার মা অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেয়ের চাকরি পাওয়ার খুশির কান্নায় তিনি কোনো কথায় বলতে পারেননি।

এদিকে জয়পুরহাট সদর উপজেলার জয়পার্ব্বতীপুর গ্রামের দিনমুজর নজরুল ইসলামের (৪৯) ছেলে নাজমুল হোসেন বাংলাদেশ পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে মনোনীত হয়েছেন। ছেলের চাকরি হওয়ার পর বাবা নজরুল ইসলামও খুশিতে আত্মহারা।

নাজমুল হোসেন চোখে খুশির জল নিয়ে বলছিলেন, আমার বাবা দিনমুজরি করেন। আমাদের সহায়-সম্পদ বলতে বসতবাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। আমার বাবা আমাকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছেন। আমার বাবার এক হাজার টাকা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। আমি মেধার ভিত্তিতে আজকে পুলিশের কনস্টেবল পদে মনোনীত হয়েছি।

এবার জয়পুরহাট জেলায় ২৫ জন কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন। এরমধ্যে চারজন নারী রয়েছেন। কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত ২৫ জনের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়ে। তাদের কেউ এতিম, আবার কারও মা-বাবা বেঁচে নেই। কারও বাবা সিএনজি চালক, রাজমিস্ত্রির সহকারী ও দোকান কর্মচারী। 

কেউ কেউ নিজেই শাক বিক্রি করে লেখাপড়া করেছেন। তারা পুলিশ কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীতদের অনেকের অভিভাবকরা বলেন, আমরা আগে শুনেছি পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি পেতে লাখ-লাখ টাকা ঘুষ লাগত। শুধু আবেদন ফি দিয়ে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি হবে তা কোনো দিন কল্পনা করিনি।

নিয়োগবিধিতে পরির্বতন আসায় তাদের মতো গরিব ঘরের সন্তানেরা পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি পাচ্ছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী,  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), পুলিশ সুপারকে (এসপি) ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তারা।

কনস্টেবল পদে মনোনীত আল-আমিন বলেন, আমি একজন এতিম। আমার বাড়ি আক্কেলপুর উপজেলার মির্জাপুর বড়গাছা গ্রামে। আমি ছোট্ট থাকতে আমার বাবা মোহসিন মন্ডল মারা যান। কিছুদিন পর আমার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার ঠাঁই হয় জয়পুরহাট সরকারি শিশু পরিবারে। সেখানেই বড় হয়েছি। আমার একটি টাকাও ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য নেই। শুধু মেধা আর যোগ্যতার ভিত্তিতে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি হবে তা কখনো কল্পনা করিনি। আমিও চাকরিজীবনে একইভাবে মানুষদের বিনা পয়সায় সেবা করব ইনশাল্লাহ।

কনস্টেবল পদে মনোনীত লাবনী সাহার বাবা লিটন চন্দ্র সাহা কাঁদতে-কাঁদতে বলেন, আমি মুদিখানার দোকানের কর্মচারী। খুব কষ্টে মেয়ের লেখাপড়া করিয়েছি। সামান্য বেতনে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। শুধু আবেদন ফি দিয়ে আমার মেয়ে কনস্টেবল পদে চাকরি পাবে তা কল্পনা করিনি। আমার মেয়ে কনস্টেবল পদে চাকরি পাওয়ায় কি যে আনন্দ লাগছে সেটি কাউকে বোঝাতে পারব না।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অনলাইনের আবেদনের পর গত ২২ মার্চ জয়পুরহাট জেলায় ২৫ জন পুলিশের কনস্টেবল পদে লোক নিয়োগের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম দিন প্রাথমিকভাবে ৮৭৬ জন  মনোনীত হন। ওইদিন ৭১৬ জন পরীক্ষার জন্য পুলিশ লাইনসে আসেন। তাদের শারীরিক উচ্চতা ও কাগজপত্র যাচাই ২৯৬ জনকে মনোনীত করা হয়। 

পরদিন ২৩ মার্চ তাদের দৌড়, পুশআপ, লং জাম্প ও জাম্প যাচাই করা হয়। এতে ২৬১ জন উর্ত্তীণ হন। ২৪ মার্চ আবারও তাদের শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করা হয়। এ পরীক্ষা শেষে ১৯২ জন উর্ত্তীণ হন। গত ২৯ মার্চ তাদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। 

৯ এপ্রিল লিখিত পরীক্ষার ঘোষিত ফলাফলে ৬৮ জন উর্ত্তীণ হন। ওইদিনই তাদের পুলিশ লাইনসের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২১ জন ছেলে আর ৪ জন মেয়ে কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন। 

এরমধ্যে পুরুষের সাধারণ কোটায় ৯ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৬ জন, পোষ্য কোটায় ২ জন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কোটায় ১ জন, আনসার কোটায় ২ জন, এতিম কোটায় ১ জন ও নারী কোটায় ৪ জন রয়েছেন।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভুঞা আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন। এ সময় বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. মোতাহার হোসেন, সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (কামারখন্দ সার্কেল) মো. শাহীনুর কবির ও জয়পুরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) তরিকুল ইসলাম ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

ফলাফল ঘোষণা শেষে পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভুঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শতভাগ মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমে এ জেলায় ২৫ জন কনস্টেবল পদে মনোনীত হয়েছে। আমার একটা প্রত্যাশা থাকবে, এখানে যারা যেভাবে নিয়োগ পেয়েছে, সম্পূর্ণ দুর্নীতি মুক্তভাবে। তারাও ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষকে যে সেবা দেবে সেটাও যেন দুর্নীতি মুক্ত, হয়রানি মুক্ত হয়। আগামী ৩০-৩৫ বছর তারা বাংলাদেশ পুলিশকে সেবা দেবে। তাদের সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের মুখ উজ্জ্বল করবে। চাকরি নয়, সেবা এ ব্রত নিয়ে কনস্টেবল পদে উর্ত্তীণরা দেশ ও সাধারণ মানুষকে সেবা দেবে এমনটায় প্রত্যাশা করছি।

চম্পক কুমার/এমএএস