পরীক্ষার হলে ফেসবুকে লাইভ করে আলোচনায় আসা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন সুমন মহিষ চুরি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।

মনির হোসেন সুমন কালীগঞ্জ পৌরসভার শিবনগর এলাকার প্রবাসী আব্দুল মান্নানের ছেলে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুমন একজন নেশাগ্রস্ত। শিবনগর এলাকার বখাটে, চোর ও নেশাগ্রস্ত যুবকদের সঙ্গে তার ওঠাবসা। নেশার টাকা জোগাড় করতেই মহিষ চুরির মতো ঘটনা ঘটায় সুমন ও তার সহযোগীরা।

জানা গেছে, কোটচাঁদপুর উপজেলার গুড়পাড়া থেকে ২০২০ সালের ১৬ জুন কৃষক নাসির উদ্দীনের দুটি মহিষ চুরি হয়। এ ঘটনায় কোটচাঁদপুর থানায় একই বছরের ২৬ জুন একটি মামলা হয়। পরে পুলিশ কালীগঞ্জ উপজেলার চাচড়া গ্রামের আজগার আলীর ছেলে সেলিমের বাড়ি থেকে একটি মহিষ উদ্ধার করে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন সেলিম। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সেখানেই নাম আসে কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন সুমনের।

আদালতে স্বীকারোক্তিতে সেলিম জানিয়েছিলেন, মহিষটি শিবনগর গ্রামের মনির হোসেন সুমন, একই গ্রামের মিলন, কোটচাঁদপুরের বলুহর গ্রামের ঢালীপাড়ার তরিকুল ও চুয়াডাঙ্গার রশিদ তার কাছে বিক্রি করেন। এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।

সেই সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোটচাঁদপুরের এসআই তৌহিদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এই মামলায় কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সেলিম। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালে প্রয়াত মেয়র মকছেদ আলী বিশ্বাসের ওপর হামলা মামলার ২ নং আসামি ছিলেন মনির হোসেন সুমন। এরপর সেই মামলা থেকে স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজীম আনারের সুপারিশে নাম কাটা যায় সুমনের। ২০২০ সালে কোটচাঁদপুরে মাদকসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন সুমন। সে সময় কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ এক নেতার হস্তক্ষেপে রক্ষা পান তিনি।

২০১৫ সালে ২ ডিসেম্বর উপজেলার বাকুলিয়া গ্রামের রাস্তা নিয়ে তখনকার পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বিজুর সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বাকবিতণ্ডা হয়। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পৌর মেয়র লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেন। কিন্তু মনির হোসেন সুমন পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা নাটক সাজান। বলেন পৌর মেয়র তার হাতে গুলি করেছেন। সেই মামলায় পৌর মেয়র কারাভোগও করেন। তবে সম্প্রতি সেই মামলা থেকে সাবেক পৌর মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান বিজুকে খালাস দিয়েছেন আদালত।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৬ জুলাই নাজমুল হাসান নাজিমকে সভাপতি ও মনির হোসেন সুমনকে সাধারণ সম্পাদক ও জাবেদ হোসেন জুয়েলকে সাংগঠনিক সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। কিন্তু মাত্র ৪ দিনের মাথায় বয়সসীমা অতিক্রম করায় সভাপতি নাজমুল হাসান নাজিম ও বিবাহের অভিযোগ থাকায় সাংগঠনিক সম্পাদক জাবেদ হোসেন জুয়েলকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। কিন্তু স্বপদে বহাল থাকেন সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন সুমন।

এর আগের সভাপতি ইসরাইল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক কাজী রিপন কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক পদে ছিলেন সুমন। তিনি স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজীম আনার গ্রুপের সঙ্গে রাজনীতি করেন। সম্প্রতি কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ প্রত্যাশী সাংসদ কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নসহ কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন সুমন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও তাকে অপছন্দ করেন। কখন কোথায় কীভাবে কথা বলতে হয় সুমন এসব বোঝে না বলে জানায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এছাড়া সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজে জোর করে ছাত্র-ছাত্রীদের ছাত্রলীগের মিছিলে আসতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিবনগর এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, নেশা আর নারী ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। সব সময় নেশাগ্রস্ত থাকায় এলাকার নারীরাও তাকে দেখে ভয়ে থাকে। কিন্তু স্থানীয় এমপির সঙ্গে রাজনীতি করায় ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না।

মনির হোসেন সুমনের এক চাচাতো ভাই জানান, প্রতিদিন ১০-১৫ পিস ইয়াবা আর দুই বোতল ফেনসিডিল না খেলে সুমনের দিন চলে না। রাত হলেই এলাকার বখাটেদের সঙ্গে চাঁচড়া শ্মশানে নেশার আসর বসায়।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে রোববার দুপুরে কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন সুমনের বক্তব্য জানতে তার মোবাইলে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এরপর বিকেলে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বিজু বলেন, ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। দায়িত্বশীল পদে থেকে ফেসবুক লাইভে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা একদমই বোকামি। এমন ছেলেদের কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরা ব্যক্তির লোক। দলের লোক হলে এমন কাজ করতে পারে না। এর আগে তার বিরুদ্ধে মহিষ চুরির মামলা হয়েছিল। দলের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির কারণে বড় বড় অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে যায়।

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে এর আগে পরীক্ষার হলে ছাত্রলীগ নেতা সুমনের ফেসবুক লাইভ দেওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এটা করতে পারে না। পরীক্ষার হলে বসে ফেসবুক লাইভ জঘন্য কাজ। এ ধরনের কাজ কারও করা উচিত নয়।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার দুপুরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ের পরীক্ষা দেওয়ার সময় ৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডের একটি লাইভ করেন তিনি। এরপর ফেসবুকে লাইভটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শনিবার রাতে কালীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য্য স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

তবে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে প্রকৃত অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। ব্যক্তি সুমনকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানায় স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। 

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মো. আনোয়ার সাঈদ বলেন, মহিষ চুরির মামলাটি আদালতে চলমান থাকায় এ বিষয়ে কথা বলতে পারছি না। তবে পরীক্ষার হলে ফেসবুকে লাইভের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আব্দুল্লাহ আল মামুন/এসপি