মা মোটরসাইকেল চালিয়ে অফিস করতেন। ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাথে মোটরসাইকেলে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর কারণে মোটরসাইকেলের প্রতি আকৃ্ষ্ট হয়ে পড়েন। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই মায়ের জাপানিজ-৫০ স্কুটি নিয়ে নিজ বাড়ির আঙিনায় চালানোর চেষ্টা করতেন। মায়ের হাত ধরেই মোটরসাইকেল চালানো শেখা। হঠাৎ একদিন মাকে না জানিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ির বাইরে চলে যান। এমন খবর পেয়ে মা মেয়ের পেছনে পেছনে ছুটতে থাকেন। সেই থেকে মোটরসাইকেল চালানো শুরু। তারপর থেকে বাইক রাইডে কেটে গেছে ১৩টি বছর।

অদম্য মনোবল আর দুরন্ত সাহসিকতায় মোটরসাইকেল চালিয়ে মাত্র ১৫ দিনে দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জামশা ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের লেডি বাইকার সুজাতা। নিজের বাইক নিয়ে গত ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিঙ্গেল রাইডে দেশের প্রথম লেডি বাইকার হিসেবে রেকর্ডও গড়েছেন। তার সফর সঙ্গী ছিল চার বছরের পোষা কুকুর জিমি।

বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে সুজাতার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আধাপাকা একটি চৌচালা টিনের ঘরে মা-মেয়ের বসবাস। সকালেই মা অফিসে চলে গেছেন। নিজের প্রিয় বাইকটি বাড়ির আঙিনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে ব্যস্ত সুজাতা। ঘরের বারান্দার সিঁড়িতে বসে আছেন তার নানি। তার বাইক পরিষ্কার করার দৃশ্য দেখছেন নানি, খালাসহ প্রতিবেশীরা।

সুজাতার বাইক চালানোর বিষয়ে তার মামা ফরহাদ হোসেন বলেন, নারী বলে তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না। কিছু তো করতে হবে। আমাদের দেশে নারীরা এখন কত কাজ করছে। অনেক পুরুষ আছে তারা নারীর চেয়ে অধম।

জয়পুরহাট সার্কিট হাউসের সামনে বাইকার সুজাতা

তিনি আরও বলেন, সুজাতা মায়ের কাছ থেকেই মোটরসাইকেল চালানো শিখেছে। এখন মোটরসাইকেল চালানো ওর নেশায় পরিনত হয়েছে। ওর সাহসিকতায় আমরা মুগ্ধ। ছেলেরা যা করতে পারেনি সুজাতা মেয়ে হয়ে সেটি করে দেখিয়েছে।

সুজাতার নানি পঞ্চবানু বলেন, সুজাতা মোটরসাইকেল নিয়ে চললে খুব ভালো লাগে। একটা নাতি নাই, এই নাতনি আমার নাতি। নয় মাস বয়স থেকে ১২ বছর পর্যন্ত ওরে পালছি। এখন আমার আর তারে পালন লাগে না সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। ১২ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালায়। সব সময় ভয়ে থাকতাম কেমনে মোটরসাইকেল চালায়,পইরা যাইবো নাকি।

হযরত শাহ জালাল (রহ.) এর মাজারে বাইকার সুজাতা

সুজাতার খালা রেজিয়া বলেন, আমার ভাগনি ছোটকাল থেকেই মোটরসাইকেল চালায়। মোটরসাইকেল চালিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এতে আমরা খুব গর্বিত। সুজাতা মেয়ে হয়ে দেশের ৬৪ জেলা ঘুরে এসেছে।

প্রতিবেশী স্বপ্না বেগম বলেন, লেখাপড়া করা অবস্থায় পুলিশে চাকরি পায় সুজাতা। কিন্তু চাকরি করলে তো মোটরসাইকেল চালাতে পারবে না, ওর মায়ের সাথে তেমন যোগযোগ করতে পারবে না। তাই চাকরি ছাইড়া বাড়ি চলে আসে। পরে আবারও মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বের হয়। একজন মেয়ে হয়ে সাথে কুকুর জিমিকে নিয়ে একা দেশের ৬৪ জেলায় ভ্রমণ করে সারাদেশ রেকর্ড করেছে সুজাতা। আমরা ওরে নিয়া গর্ব করি। সমানে ওর ইচ্ছা বিদেশ ভ্রমণ করা। ওই মোটরসাইকেলটিই সুজাতার সঙ্গী।

চায়ের দেশ মৌলভীবাজারে নারী বাইকার সুজাতা

সুজাতার মা আকলিমা মমতাজ শান্তি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুজাতা ছোটবেলা থেকেই মোটরসাইকেল চালায়। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। একা মোটরসাইকেল নিয়ে টেকনাফ-তেঁতুলিয়া ভ্রমণ করে। তারপরে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছে।

তিনি আরও বলেন, মোটরসাইকেল নিয়ে যখন ৬৪ জেলা ভ্রমণের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল তখন আমার খুব দুঃচিন্তা হচ্ছিল। রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে কি-না? ভ্রমণ শেষে আমার কাছে ফিরে আসার পরে আমি অনেক খুশি। মেয়ে বাইকার হিসেবে প্রথম রেকর্ড করায় আমি মা হিসেবে গর্বিত।

নিজ বাড়িতে সুজাতা

সুজাতার মা জানান, ১৯৯১ সালে নবাবগঞ্জের শোল্লা ইউনিয়নের বাসিন্দা মোবজেল হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের ছয় বছর পরে তার কোল জুড়ে আসে সুজাতা। পারিবারিক কলহের জেরে ১৯৯৭ সালে ১১ মাসের সুজাতাকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসেন তিনি। তারপর স্বামীর সাথে সংসার জীবনের ইতি টানেন। এরপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়েও করেননি।

পরবর্তীতে জামশা ইউনিয়নের নারী ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন। দীর্ঘ তিন বছর জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। পরে সরকারি চাকরি হওয়ায় স্বেচ্ছায় ইউপি সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি নেন। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে সিংগাইর উপজেলা ভূমি অফিসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ ২৩ বছর বাবার বাড়ি থেকে মেয়ে সুজাতাকে মানুষ করার জন্য সংগ্রাম করে চলছেন আকলিমা মমতাজ শান্তি।

মোটরসাইকেল চালিয়ে ৬৪ জেলায় ভ্রমণ করার বিষয়ে লেডি বাইকার সুজাতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মায়ের কাছ থেকেই মোটরসাইকেল চালানো শিখেছি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং সিঙ্গেল রাইডে আমার কুকুর জিমিকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করার প্রেরণাই আমার মা।

সুজাতা বলেন, ২০১৯ সালে ২৯ অক্টোবর ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায় এবং চুয়ালে ফ্যাকচার হয়। অনেকেই ভেবেছিল যে ওই দুর্ঘটনায় মারাই গেছি। দুর্ঘটনায় ২৫ দিন মোটরসাইকেল ছাড়া বিছানায় কাটাতে হয়। তখন আমার মায়েক কাছে এলাকার অনেকেই বলতো মেয়েকে আর বাইক দিও না। এ কথা শুনে আমার মধ্যে জেদ কাজ করে কেন আমি বাইক ছাড়া থাকবো? আমিতো বাইক ছাড়া চলতে পারবো না। দুই চাকার প্রতি এতোটাই লোভ আর ভালোবাসা যে দুর্ঘটনার ২৬ দিনের দিনই আবারও নিজের বাইক নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে যাই। শুরু করি বাইক রাইড।

পাবনা সার্কিট হাউসের সামনে বাইকার সুজাতা

তিনি বলেন, ভাঙা পায়ে রিং পড়ানো অবস্থাতেই ডে ট্যুারগুলো করতাম। পা থেকে রিং খুলে ফেলার পরই প্রিয় কুকুর জিমিকে সাথে করে নিজের সাইক নিয়ে একাই ৬৪ জেলা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। এর আগে দেশের প্রথম লেডি বাইকার হিসেবে সিঙ্গেল রাইডে মাত্র ২৮ ঘণ্টায় বাইক চালিয়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ভ্রমণ করার রেকর্ড করেছি। আমি সাভার জোনের ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাবের একজন সক্রিয় সদস্য।

লেখাপড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে লেডি বাইকার সুজাতা বলেন, গোলাইডাঙ্গা হাই স্কুল থেকে ২০১৫ সালে এসএসসি এবং মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করেছি। বর্তমানে ঢাকার বেসরকারি প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ৬ষ্ঠ সেমিস্টারে পড়ছি। এর মাঝে ২০১৭ সালে পুলিশ সদস্য হিসেবে বেশ কিছু দিন চাকরিও করেছি। তবে নিজের বাইক চালাতে না পারা আর পুলিশের চাকরিতে মায়ের ইচ্ছা না থাকায় এক বছর পরেই স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে আসি।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়ে সুজাতা বলেন, ৬৪ জেলা ভ্রমণে সব জেলার সার্কিট হাউসের সামনে ছবি তুলেছি। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরেছি এবং বিভিন্ন জেলার ইয়ামাহা রাইডার্স ক্লাবের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথে বাইক চালানো চ্যালেঞ্জিং ছিল। পাহাড়ি রাস্তায় থামলেই উৎসুক জনতা আমাকে দেখতে ভিড় জমাতো। একজন মেয়ে একা মোটরসাইকেল নিয়ে দেশ ভ্রমণ করছে শুনেই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। এটা আমার কাছে খুব ভালা লেগেছে। আর আমার প্রিয় কুকুর জিমিকেও ৬৪ জেলা ঘোরাতে পেরেছি। বাইক চালানো আমার নেশায় পরিণত হয়েছে।

বাইরের দেশের নারীরা বাংলাদেশের নারীদের অনেক অবহেলা করে। তারা ভাবে বাংলাদেশি নারীরা কিছুই করতে পারে না। বাইক রাইড করে এমন কিছু করতে চাই যাতে লেডি বাইকারের কথা চিন্তা করতে গেলে লেডি বাইকার সুজাতার কথা মনে পড়ে। দেশ ভ্রমণ শেষ করে বিশ্ব ভ্রমণে বের হতে চান লেডি বাইকার সুজাতা।

আরএআর/এসপি