পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন শাহানা বেগম ও তার স্বামী। করোনায় চাকরি হারালে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করেন। কয়েক দিন পর সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে এক হাত হারান। চিকিৎসা নিতে গিয়ে আগের জমানো সব পুঁজি শেষ করেন। তারপর শেষ আশ্রয় হয় বোনের জায়গায়। সেখানে গড়ে তোলেন টিনের চালাঘর।

কিন্তু শাহানা এখন সেই আশ্রয়টুকুও হারাতে বসেছেন। অভাবে পড়ে তার বড় বোন চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য তারও শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দিচ্ছেন। একদিকে শাহানার অভাব-অনটন, আরেক দিকে নেই মাথা গোঁজার মতো কোনো ঠাঁই। চরম হতাশায় স্বামী-সন্তান নিয়ে দিন কাটছে তার।

শাহানা বেগমের বাড়ি পঞ্চগড় শহরের পূর্ব জালাসী এলাকায়। তিনি ওই এলাকার আনোয়ার হোসেন শান্তর স্ত্রী। পরিবারে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে।

জানা যায়, ঢাকা থেকে ফিরে আনোয়ার হোসেন পঞ্চগড়ের একটি হোটেলে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর শাহানা বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। দুজনের সামান্য আয়ে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছিলেন। এদিকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ আবেদন করেন শাহানা বেগম। ভেবেছিলেন ওই টাকা দিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে পোশাক তৈরি করে বাজারে বিক্রি করবেন।

কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না তার। টাকার খোঁজ নিতে গিয়ে গত বছরের ২৫ মার্চ একটি বেপরোয়া ট্রাকের চাপায় আহত হন শাহানা। পরে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন হাত কেটে ফেলতে হবে। পরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের পুঁজিসহ ধারদেনা করে ৪ লাখ টাকা খরচ করেন। এতে পরিবার হয়ে পড়ে নিঃস্ব।

এমন অবস্থায় মানবতার দৃষ্টিতে কয়েক মাস আগে এক ব্যক্তি শাহানাকে একটি কৃত্রিম হাত সংযোজনের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু এটি কোনো কাজে আসছে না। এদিকে থাকার জায়গাটুকুও নেই। তাই অতিকষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন তারা।

শাহানার বেগম তার বোনের দেওয়া জমিতে বসবাস করার পাশাপাশি এক হাতে বাড়ির পাশে চাষ করেছিলেন নেপিয়ার ঘাষ আর বিভিন্ন শাকসবজির। অন্যদিকে স্বামীকে একটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করে কিনে দিয়েছেন ব্যাটারিচালিত ভ্যান। সপ্তাহে ১ হাজার ৩৫০ টাকা ঋণের কিস্তি দিতে হয় তাকে। আর এভাবে চলছে তাদের সংসার। প্রতি মাসে মেয়ের পেছনে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয় । টাকার অভাবে মেধাবী মেয়ে রোজ তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যায়। বিদ্যুৎহীন বাড়িতে অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসবাস করেন তারা।

শাহানা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় চাকরি হারিয়ে বাড়িতে এসে সেলাইয়ের কাজ করতাম। হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাত হারিয়ে ফেলি। হাতের চিকিৎসা করতে গিয়ে সব শেষ করেছি। পরে আমার বড় বোন তার জমিতে বসবাস করার সুযোগ দেন। আমার বোনও আমার সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তার চিকিৎসা এখনো চলছে। আমি তার দেওয়া জমিতে বসবাস করছি। বাড়ির আশপাশে ঘাষ ও শাকসবজি চাষ করছি। তা বিক্রি করে আর স্বামীর আয়ে কোনো রকম সংসার চালাই।

তিনি বলেন, বোনেরও অভাবের কারণে আমাদের এখন জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তাই আমরা হতাশায় দিন কাটাচ্ছি। আমাদের কোনো জায়গা-জমি নেই। কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব? সরকার যদি একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে হয়তো কোনো রকম দিন কাটাতে পারব।

স্বামী আনোয়ার হোসেন শান্ত বলেন, চাকরি হারিয়ে পঞ্চগড়ে ফিরে আমি প্রথমে হোটেলের কাজ করতাম। পরে আমার স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার পর যা টাকাপয়সা ছিল, তা শেষ করে পথে বসে গেছি। পরে ধারদেনা করে একটি ভ্যান কিনে এখন কোনো রকম সংসার চালাই। আমার নিজের কোনো জায়গা-জমি নেই। তাই মানুষের জমিতে বসবাস করে দিন কাটাই। এখন সেই আশ্রয়স্থল ছেড়ে দিতে হচ্ছে। তাই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে হতাশা আর দুশ্চিন্তায় দিন পার করছি।

শাহানার প্রতিবেশী মমতাজ বেগম বলেন, শাহানা ও শান্ত তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোনো রকম ওই জমিতে ঘর তুলে বসবাস করে। কিন্তু এখন সেই জায়গা তাদের ছেড়ে দিতে হবে। তাই সরকার যদি এই পরিবারের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে হয়তো তারা আবারও নতুন করে বাঁচতে পারবে।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদুল হক বলেন, শাহানা বেগমের বিষয়ে আমরা জানা ছিল না। তার মতো অসহায় নারীদের জন্য সরকার কাজ করছে। আমরা ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ করে দিচ্ছি। শাহানা চাইলে তার মাথা গোঁজার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হবে।

এনএ