গ্রামের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতেই কানে ভেসে আসে খুটখুট শব্দ। বুঝতে বাকি নেই যে প্রতিটি বাড়িই একেকটি কারখানা। এসব কারখানায় ঘূর্ণমান কাঠের টুকরায় বাটালির ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে বাহারি ফুলদানি, মোমদানি, কলমদানি, পাউডার কেস, খুনতি, হামাম, কিংবা রুটি বেলার বেলন।

যশোরের কেশবপুরের আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোটকে বলা হয় কুটিরশিল্পের গ্রাম। উপজেলার এ চারটি গ্রামের ৫০০ পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে কাঠের শিল্পের ছোঁয়ায়। আর কুটিরশিল্পের এসব জিনিস থেকে চার গ্রামে বেচাকেনা হয় প্রায় ১০ কোটি টাকার।

কুটিরশিল্পের মালিকরা বলছেন, এক যুগ আগেও গ্রামগুলোর অনেক মানুষ কাজের অভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেত। এখন তারাই সারা দিন থাকে কর্মমুখর। নিজেদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও এসেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। তবে সরকারি সহযোগিতা পেলে আরও সমৃদ্ধ হতে পারবেন বলে আশা করছেন শিল্পীরা।

জানা যায়, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে কেশবপুর উপজেলার আলতাপোল গ্রামের ইনসার আলী ভারত থেকে শিখে এসে কাঠের কাজ শুরু করেন। অল্প দিনেই সফলতার মুখ দেখেন তিনি। তার তার সাফল্যে উদ্ধুদ্ধ হয়ে এ কাজে যুক্ত হন আলতাপোল, কন্দর্পপুর, বড়েঙ্গা ও মঙ্গলকোটসহ আশপাশের গ্রামগুলোর অনেকেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় এ চারটি গ্রামকে ‘শিল্পপল্লি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাদের ভাষ্য, বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় কেশবপুরের এ কুটিরশিল্প এখন চারটি গ্রাম ছাড়াও ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের গ্রামেও। প্রতি পরিবারের নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও এখন কাঠের শিল্পে পারদর্শী। নারীরা নিয়মিত এ কাজে যুক্ত হওয়ায় আয় বেড়েছে পরিবারের। বর্তমানে কেশবপুরের ওই চার গ্রামেই রয়েছে এ রকম অন্তত ৪০০ কারখানা। এসব কারখানায় মালিক-শ্রমিক ও কাঠ ব্যবসায়ী মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।

আলতাপোল গ্রামের বাসিন্দা কারখানার মালিক সাধন কুমার রায় বলেন, এক যুগ আগেও অন্যের জমিতে কামলা খাটতেন তিনি। গ্রামের ইনসার আলীর দেখাদেখি শুরু করেন কাঠের ব্যবসা। নিজের বাড়িতেই একটি কারখানা স্থাপন করেন। পরে মেহগনি কাঠ থেকে মোমদানি, ফুলদানি, কলমদানি, বাটি, পাউডার কেস, বয়াম, ডিম সেট, আপেল সেট, খুনতি, হামাম, পিঁড়ি, মেয়েদের চুড়ি রাখার আলনা, হারিকেন, পেনসিল, অ্যাশট্রে, সিদুর বক্স, ধামাপাতি, খয়েরদানি, টিফিন বক্সসহ নানা ধরনের শোপিস তৈরি করতে থাকেন।

তিনি আরও বলেন, প্রথমে স্থানীয় বাজারে এগুলো বিক্রি শুরু করলেও পরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, বাগেরহাট, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে। বর্তমানে তার কারখানায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতি মাসে তার ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বেচাকেনা হয় বলে জানান তিনি।

উজ্জল কুমার দাস নামে এক শ্রমিক বলেন, মূলত এসব জিনিসপত্র তৈরির উপাদান মেহগনিকাঠ। প্রথমে আমাদের মহাজন স-মিল থেকে কাঠ কেটে নিয়ে আসেন। কাঠ কেটে কাঠের ছাল ওঠানো হয়। সেখান থেকে কাঠগুলো শুকানো হয় দুই থেকে তিন দিন। তারপর কারখানা এনে বিদ্যুচ্চালিত মটরের চাকায় লাগিয়ে ঘূর্ণমান কাঠের টুকরোতে বাটালির ছোঁয়ায় তৈরি করি নানা রকমের পণ্য। পরে রং করে রোদে শুকায়ে মহাজনের কাছে বুঝিয়ে দিই। মহাজন আমাদের পিস হিসেবেই মজুরি দেয়।

ভাই ভাই কুটিরশিল্পের শ্রমিক তন্ময় রায় বলেন, প্রতিদিন ভোর থেকে কাজ শুরু করি। দুপুরে ঘণ্টাখানেকের একটা বিরতি দিয়ে কাজ শেষ করি সন্ধ্যায়। আট ইঞ্চি হামাম বানালে আমাদের মজুরি দেয় ৩০ টাকা, ৪ ইঞ্চি বানালে ৪ টাকা, ৭ ইঞ্চ বানালে ১৫ টাকা করে দেয়। সব মিলিয়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি ওঠে বলে জানান তিনি।

প্রতিদিন সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০টি তৈজসপত্র তৈরি করতে পারেন শ্রমিক সফিউল। তিনি জানান, গড়ে দিনে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাদের। এ কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চলছে তাদের।

কাঠশিল্পী কামরুল ইসলাম জানান, কেশবপুরে এ রকম চার শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে বাড়িতে বাড়িতে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ কাজে যুক্ত রয়েছে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। কেশবপুরের গ্রামে তৈরি এসব কাঠের সামগ্রী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। পাইকাররা বাড়ি এসেই কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

ভাই ভাই কুঠির শিল্পের স্বত্বাধিকারী কবির হোসেন জানান, বেশ আগে থেকেই এ কাজ শুরু হলেও এর ব্যাপকতা লাভ করে এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ-সংযোগ আসার পর। তার অধীনে অর্ধশতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। অনেক শ্রমিক মাসিক বেতনে কাজ করলেও অনেকে কাজ হিসেবে টাকা নিয়ে থাকেন। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে অর্ধলক্ষাধিক টাকা লাভ থাকে তার।

নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, কেশবপুরে উপজেলার চারটি গ্রামের পাঁচ শ’ পরিবার এই কুঠির শিল্প করেছে স্বাবলম্বী। কুঠির শিল্পের এসকল জিনিসপত্র কেনাবেচায় মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা লেনদেন হয় গ্রাম চারটিতে। একসময় গ্রামগুলোর অনেক মানুষ কাজের অভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেত। চার গ্রামে এখন কেউ বেকার বসে থাকে না। সবাই কোনো না কোনোভাবে এ কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দিন-রাত এসব কারখানায় কাজ হয়। অনেক নারী শ্রমিকও কাজ করছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তাদের তৈরি কাঠের পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। এতে এ শিল্প আরও ব্যাপকতা লাভ করবে।

কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, বংশপরম্পরায় এতগুলো পরিবার এই পেশায় জড়িত। গ্রামগুলোকে একেকটি কারখানা মনে হয়। ইতিমধ্যে বিআরডিবির পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামগুলোকে শিল্পপল্লি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উন্নত প্রশিক্ষণ, ঋণদান কর্মসূচিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে অর্থসহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকে পাবেন পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণসহায়তা।

এনএ