সাতক্ষীরার তালায় কলেজছাত্রকে অপরহণের পর নির্যাতন, বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ ও মুক্তিপণ দাবি করেছে ছাত্রলীগের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার কলেজছাত্র শোয়েব আজিজ তন্ময় (২০) তালা সদরের জাতপুর গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ী শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে। সে চলতি বছর জাতপুর টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য খুলনায় কোচিং করছে।

গতকাল রোববার (২৪ এপ্রিল) দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তার ওপর নির্যাতন চালিয়ে মাথা ন্যাড়া এবং তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও করা হয়। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিয়ে এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে পরিবারটি।

কলেজছাত্র তন্ময়ের বাবা আজিজুর রহমান জানান, ওরা আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিল। আমার জানা মতে ওদের সঙ্গে তন্ময়ের কোনো বিরোধ নেই। একসঙ্গে পড়েও না। আকস্মিক রোববার (২৪ এপ্রিল) দুপুর ১টার দিকে আমার ছেলের পূর্ব পরিচিত নাহিদ হাসান উৎস্য নামে এক ছেলে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে যায় তালা কলেজের সামনে।

সেখান থেকে তন্ময়কে ধরে নিয়ে যায় কলেজের মধ্যে একটি রুমে। সেখানে নিয়ে তাকে মারপিট, মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া ও উলঙ্গ করে ভিডিওধারণ করা হয়। তারপর আমার স্ত্রীর কাছে ফোন করে ছেলেকে ফিরে পেতে দুই লাখ টাকা নিয়ে কলেজের সামনে যাওয়ার কথা বলে। ওপ্রান্ত থেকে ছেলেকে মারপিটের চিৎকার শোনাচ্ছিল তারা।

আজিজুর রহমান আরও বলেন, সন্ধ্যার দিকে ছেলেকে উদ্ধার করার পর তালা হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাতে থানার মধ্যেই আমাকে হুমকি দিতে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা এক সন্ত্রাসীর বাবা।

কি কারণে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে প্রশ্নে তিনি বলেন, ধারণা করছি আমার ছেলের নতুন মোটরসাইকেলটি তারা নিয়ে নিতে চেয়েছিল। এ কারণেই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।

ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা হলেন, তালার মাঝিয়াড়া গ্রামের দালাল নামে খ্যাত সৈয়দ ইদ্রিসের ছেলে সৈয়দ আকিব (২৫), হরিশচন্দ্রকাটি গ্রামের গণেশ চক্রবর্তীর ছেলে সৌমিত্র চক্রবর্তী (৩২), তালা গার্লস স্কুলের পেছনের বাসিন্দা জে.আর সুমন (২৫), তালার মহান্দি গ্রামের জয় (২৪) ও তালা সদরের নজির শেখের ছেলে নাহিদ হাসান উৎস (২৪)।

এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সৈয়দ আকিব তালা উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সৌমিত্র চক্রবর্তী উপজেলা শ্রমিকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। বাকিরা ছাত্রলীগের কর্মী।

নির্যাতনের শিকার কলেজছাত্র শোয়েব আজিজ তন্ময় ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাহিদ হাসান উৎস্য আমার পূর্ব পরিচিত। তালা বাজারে যাতায়াতের সুবাদে পরিচয়। আমাকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আকস্মিক মারপিট শুরু করে আকিবসহ অন্যরা। কলেজের পশ্চিম পাশে একটি রুমের মধ্যে নিয়ে টানা ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন চালায়। হাতে, পায়ে নির্মমভাবে মারপিট করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। এরপর বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে। তারপর বাড়িতে ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

তিনি আরও জানান, যে রুমের মধ্যে আমাকে আটকে রেখেছিল সেটা সম্ভবত কলেজের ছাত্রবাসের কক্ষ। সেটি কলেজের মধ্যেই অবস্থিত। ওই রুমের মধ্যে মারপিট করার জন্য বেল্ট, লাঠিসোটা এখনো রয়েছে। তালা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিলন রায় বলেন, নির্যাতনের ঘটনা আমার জানা নেই। সৈয়দ আকিব আমাদের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছে।

তন্ময় বলেন, তাদের বার বার অনুরোধ করেছিলাম, আমি রোজা আছি আমাকে আর মেরো না, তবুও শোনেনি ওরা। তারপরও আমাকে বিবস্ত্র করে বেধড়ক পিটিয়েছে। কথা বল্লেই মেরেছে। বেশি মেরেছে আকিব নামের ছেলেটা। পরে এ ঘটনা বাড়ির দিকে জানাজানি হলে, আমার চাচাতো ভাইয়েরা আমাকে উদ্ধার করতে সেখানে যায়। তাদেরকেও মারপিট করে। এক পর্যায়ে সেখান থেকে আমার চাচাতো ভাইয়েরা আমাকে উদ্ধার করে তালা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে।

তালা সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর সেখ মো. হুমায়ূন কবীর জানান, আমরা এ ধরনের কোনো ঘটনার খবর জানি না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কলেজে টর্চার সেল করেছে এটি আমার জানা নেই।

তালা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মিলন রায় বলেন, নির্যাতনের ঘটনা আমার জানা নেই। সৈয়দ আকিব আমাদের কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আশিকুর রহমান আশিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি এখনো কেউ জানায়নি। খোঁজখবর নিয়ে ঘটনার সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি আমাকে আগে কেউ জানায়নি। এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হবে। তাছাড়া যেহেতু মামলা হয়েছে ঘটনাটি যেন সুষ্ঠ তদন্ত হয় ও দোষীরা শাস্তি পায়।

এদিকে, তালা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া কলেজছাত্র শোয়েব আজিজ তন্ময়কে  সোমবার (২৫ এপ্রিল) বেলা ১২টায় বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হুমকি ধামকি দিচ্ছে বলে জানান তন্ময়ের বাবা আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। গত রাতে থানাতেও আমাকে মামলা না করার জন্য হুমকি দিয়েছিল।

তালা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি-তদন্ত) আবুল কালাম জানান, এ ঘটনায় অভিযুক্তরা পলাতক রয়েছে। এখনো মামলা হয়নি। মামলার বাদী আর্জির সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ড জমা না দেওয়ায় রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি। হুমকি ধামকি দিচ্ছে এমন ঘটনা আমার জানা নেই।

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

আকরামুল ইসলাম/এমএএস