১৯৯৭ সালে এনামুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয় রেনুয়ারা বিবির। বিয়ের পর থেকেই যৌতুক ও নেশার জন্য টাকার জন্য রেনুয়ারার ওপর শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন। এরই মধ্যে তাদের সংসারে দুই মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তারা এখন বড় হয়েছে। কিন্তু রেনুয়ারার ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। এক পর্যায়ে ২০১৪ সালে রেনুয়ারাকে তালাক দিয়ে দেন স্বামী এনামুল হক। নিরুপায় হয়ে রেনুয়ারা সহায়তা নেন লিগ্যাল এইডের।

এরপর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার দু’পক্ষকে নিয়ে মীমাংসায় বসেন। মীমাংসার মাধ্যমে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। মীমাংসায় সন্তানদের জিম্মার বিষয়টি চুক্তি মোতাবেক স্থির করা হয়। এভাবে লিগ্যাল এইড অফিসে সমঝোতায় উভয় পক্ষ রাজি হলে তাদের পারিবারিক কলহের নিষ্পত্তি হয়।

রেনুয়ারা বলেন, স্বামীর সঙ্গে সংসার করার ১৬ বছরে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এরপর স্বামী আমাকে তালাক দেয়। কোনো উপায় না পেয়ে লিগ্যাল এইডে আশ্রয় নেই এবং সেখানে বিচার পেয়েছি।

লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে পারিবারিক বিরোধ থেকে নিষ্পত্তি পাওয়া আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, এগারো বছর আগে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে স্বামী নেশার টার জন্য আমাকে মারধর করত। আমাদের একটি মেয়ে হয়। তবুও কোনোভাবেই স্বামীর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। তাই আদালতে মামলা করার চিন্তা করি। কিন্তু মামলা করলে তালাক ও দেনমোহর সংক্রান্ত এবং সন্তানদের হেফাজতে নেয়া ও ভরণ-পোষণসংক্রান্ত মামলা করতে হবে। এতে আমার অনেক টাকা খরচ হবে। তাই আমি লিগ্যাল এইড অফিসে অভিযোগ করি এবং সাত মাসে অফিযোগটি নিষ্পত্তি হয়।

শুধু পারিবারিক এমন বিষয়ই নয়। জমি সংক্রান্তসহ নানান বিষয়ের সমাধান কম সময়ে সরকারি খরচে করেছে জয়পুরহাট লিগ্যাল এইড অফিস। 

লিগ্যাল এইড অফিস জানিয়েছে, ২০১৯-২০ ও ২১ সালের এই তিন বছর এবং চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩১২টি এডিআর বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জমা পড়ে। এরমধ্যে ১ হাজার ৩০টি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির মধ্যে মামলা দায়েরের আগেই (প্রি-কেইস) ৫৭১টি এডিআর ও মামলা দায়ের পর বা চলাকালীন সময়ে (পোস্ট-কেইস) ৫৫৯টি এডিআর বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এই সময়ে ১ হাজার ২৪১টি আইনগত পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ১ হাজার ২০২টি দায়ের করা মামলায় আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জয়পুরহাট জজ কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি নৃপেন্দ্রনাথ মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমানে জয়পুরহাট জেলায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর কারণ বিচারকের স্বল্পতা, বিভিন্ন স্ট্রেক হোল্ডারদের অনিহা। এমন কারণে সরকার লিগ্যাল এইড সিস্টেম ও কমিটির মাধ্যমে মামলার হার কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আশা করি আমরাও জয়পুরহাটে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারব।

লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী জজ ও লিগ্যাল এইড অফিসার সামিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিগ্যাল এইড অফিস দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য একটা আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে। যে সমস্ত মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও ভোগান্তির কারণ হয়, সেই সমস্ত মামলা লিগ্যাল এইডের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা ফিরে পেয়েছে।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিচার করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক সময় উভয়পক্ষের মধ্যে আপোস মীমাংসার আকাঙ্খা থাকলেও স্ট্রেডিশনাল বিচার ব্যবস্থাতে এ বিষয়টাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ থাকে না। তাই এরকম কোনো মামলা হলে তা আমি সরাসরি লিগ্যাল এইড অফিসে প্রেরণ করি এবং সেখানকার বিচারক তা নিষ্পত্তি করেন। এভাবে যদি আমরা মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারি তাহলে আমাদের যে অনেক মামলার একটা সংখ্যা রয়েছে এবং মানুষদের ভোগান্তিটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

জেলা প্রশাসক মো. শরীফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দেশের অস্বচ্ছল নাগরিকের আইনগত সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে করে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষ উপকারের মধ্য দিয়ে ন্যায় বিচার পাচ্ছে।

জেলা ও দায়রা জজ মো. নূর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের আইনাঙ্গনে দীর্ঘসূত্রিতা একটি সমস্যা। এটি জাতীয় সমস্যাও বলা যায়। প্রচুর মামলা। সেই মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে। দ্রুত সময়ে কি করে বিচার নিষ্পত্তি করা যায় তা নিয়ে কাজ করছি। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মানুষ শুধু আদালত মুখি না হন, মীমাংসার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যাগুলো নিজেরা সমাধান করতে পারে। এ ব্যাপারে জাতীয় আইনগত সংস্থার অধীনে আমাদের লিগ্যাল এইড অফিস সহযোগিতা করছে। আমাদের লক্ষ্য বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি করা।

এমএএস