বোরো ফসলের অফুরন্ত ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত হাওর অধ্যুষিত জেলা কিশোরগঞ্জ। হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম বোরো ফসল। এ ফসলকে ঘিরেই এখানকার কৃষিজীবীরা সারা বছর সংসার চালানোর স্বপ্ন দেখেন। 

হাওরবাসীর কাছে বৈশাখ মানে কষ্টে ফলানো একমাত্র সোনালী বোরো ফসল ঘরে তোলার আনন্দ। সেই সোনালী ধানের মাঝে ঘিরে থাকে একেকটা পরিবারের নানা রকম স্বপ্ন। কারও সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, কারও মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আবেগ। তবে মাঝে মাঝে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেলায়। 

কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনার ধনপুর ইউনিয়নের আফান্নের হাওরের পাশেই ঘোষপাড়া গ্রাম। সেই গ্রামের অখিল ঘোষ (৪৫) চার একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। সোনালী বোরো ফসল কেটে বড় মেয়ে অনামিকা ঘোষকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অখিল ঘোষের সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। উজানের ঢলে তলিয়ে গেছে তার সকল স্বপ্ন। বড় মেয়কে বিয়েতো দূরের কথা তিন মেয়ে ও পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতেই এখন তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। না পারছেন মেয়েকে বিয়ে দিতে, না পারছেন অন্য তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে, না পারছেন সারাবছর খেয়ে বাঁচতে, না পারছেন ঋণ পরিশোধ করতে।

সরেজমিনে দেখা গেছে,  গত ২ এপ্রিল উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যায় কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ধনপুর ইউনিয়নের আফান্নের হাওর। সেই হাওর পাড়ের বাসিন্দা অখিল ঘোষ। স্ত্রী সরস্বতী রাণী ঘোষ (৪০), বড় মেয়ে অনামিকা ঘোষ (১৯), মেজো মেয়ে অন্তরা ঘোষ (১৬) ও যমজ দুই মেয়ে আখি ঘোষ (৭) এবং সুখী ঘোষকে (৭) নিয়ে সংসারে লোক সংখ্যা ছয়জন। এক ফসলি জমি বার্গা নিয়ে বোরো চাষের আয় দিয়েই সারা বছর চলতে হয় তাদের।

 এ বছর চার একর জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছিলন অখিল ঘোষ। চার একর জমি চাষ করতে তিনি এনজিও ও ব্যাংক থেকে প্রায় ৯০ হাজার টাকা ঋণ করেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন ওই জমিতে দুইশ মণ ধান হবে। আর সেই ধান বিক্রি করে বড় মেয়েকে বিয়ে দেবেন। ছোট তিন মেয়ের পড়ার খরচসহ চলবে সংসারের খরচ। অখিলের সেই স্বপ্ন আজ উজানের ঢলে ভেসে গেছে। এখন কান্না ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সারা বছর সংসার চালনোই এখন চিন্তার বিষয়। মানুষের জমিতে কাজ না করলে জুটবে না তিনবেলা খাবার। 

ঘোষপাড়ার প্রায় ৮০ ভাগ কৃষকের স্বপ্নই ভেসে গেছে উজানের ঢলে। সরকার এখন তাদের সহযোগিতা না করলে সংসার চালানোই এখন তাদের কষ্ট হয়ে যাবে বলে জানান স্থানীয়রা। 

ঘোষপাড়ার অখিল ঘোষের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বাড়িতে নেই। মানুষের জমিতে দৈনিক মজুরিতে ধান কাটতে গেছেন। ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন অখিল ঘোষের স্ত্রী সরস্বতী রাণী ঘোষ। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী বাড়িতে নেই। তিনি মানুষের জমিতে কাজে গেছেন ভোরে। এবার তিনি চার একর জমি ১২ হাজার টাকায় বর্গা নিয়ে চাষ করেন। সব মিলিয়ে খরচ হয় ৯০ হাজার টাকা। এই টাকাগুলো ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বোরো ধান চাষ করেন। লাখ টাকার মতো খরচ হলেও আড়াই লাখ টাকার ধান বিক্রি করতে পারবেন সেই স্বপ্ন নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। ঋণ দিয়ে বাকি টাকায় বড় মেয়ের বিয়েসহ সংসারের খরচ ও ঘর তৈরি করার কাজে ব্যয় করতেন। কিন্তু উজানের ঢলে সব স্বপ্নেই ভেসে গেছে। 

তিনি আরও বলেন, এখন মেয়ের বিয়েতো আর এই বছর হবে না। সারা বছর চলব কী করে। ছোট তিনটি মেয়ে লেখাপড়া করে তাদের খরচ ও ঋণ পরিশোধ করব কী করে। সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা না করে, তাহলে মরণ ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

রিপন কুমার ঘোষ নামে তাদের এক প্রতিবেশী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অখিল ঘোষের মতো এই ঘোষপাড়ার ৮০ ভাগ পরিবারই কৃষক। এবার উজানের ঢলে তাদের সবার ক্ষতি হয়েছে। আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা বলে বুঝানো যাবে না। যাদের জমি তলিয়ে গেছে তাদের সবার ঋণ আছে। এখন গোয়ালের গরু সস্তায় বিক্রি করছে। জমির ধানতো নষ্ট হয়েছে, গরুর খাদ্যও নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের সংসার চালানোর মতো অবস্থা এখন আর নেই। ঋণগুলো যাতে কিছুটা মওকুফ হয় সরকারের কাছে সেই দাবি জানাই। 

নিমাই ঘোষ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই বছর উজানের ঢলে আমাদের এলাকার কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি আগামী বৈশাখ না আসা পর্যন্ত পুষিয়ে নিতে পারবে না। আমরা এই বৈশাখ থেকে আগামী বৈশাখ পর্যন্ত কী খেয়ে বেঁচে থাকব? 

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ছাইফুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ৭০৫ হেক্টর উঠতি বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করছি। যদি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রণোদনা বা পুনর্বাসন  কর্মসূচি দেওয়া হয়, তাহলে এই তালিকা থেকে কমিটির মাধ্যমে মনোনীত কৃষকদেরকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করব। আমরা এই ধরনের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।

আরএআর