ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি দিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। তবে ভাগ্য সহায় হয়নি। ভিসার মেয়াদ শেষে লুকিয়ে কিছুদিন কাজ করার পর সেদেশের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। কোনো পুঁজি ছাড়ায় দেশে ফিরতে হয়। দেশে এসে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এরই মধ্যে পরিবার নিয়ে পড়েন বিপাকে। অন্যের দোকানে কিছুদিন কাজও করেন।

পরে স্বল্প পুঁজি নিয়ে নেমে পড়েন মাঠে। ঘরের সামনে গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি নার্সারি। নিজেই সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করেন টব। বিক্রির জন্য খোলেন নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ফেসবুক পেজ। 

বলছিলাম শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার কুলকুড়ি এলাকার সাইফুল ইসলাম নাহিদের কথা। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ভাইদের নিয়ে নাহিদের বসবাস। 

জীবন সংগ্রামের কথা ঢাকা পোস্টের কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে নাহিদ বলেন, জীবনের তাগিদে ২০১০ সালে মালশিয়া যাই। পরে একটি কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। দিন-রাত পরিশ্রম করতাম। কিন্তু বেতন কম হওয়ায় তা দিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যেত। কয়েক বছর থাকার পর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে অবৈধভাবে কয়েক বছর কাজ করি। তাও বেশি দিন থাকতে পারিনি।

আটক করে পুলিশ দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে এসে পুরো পাগল হয়ে যাই। কী করব, কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পাছিলাম না। অনেক দিন বেকার ছিলাম। পরে ভাবলাম সিমেন্টের টব বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা যায় কি না। 

পরে অল্প পুঁজি নিয়েই নেমে পড়ি এ ব্যবসায়। অনলাইনে ব্যবসাটি করব বলে চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে একটি ফেসবুক পেজ খুললাম। পরে কয়েকটি টব বানিয়ে তার ছবি ফেসবুকে ছাড়লাম। এ থেকেই শুরু। এখন আমার টব তৈরিতে দুই জন ও নার্সারিতে একজন শ্রমিক কাজ করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আমার টবের ডিজাইন করে। এতে তাদের আমি পারিশ্রমিক প্রদান করি। চাহিদা যেমন বেড়েছে তেমন কর্মসংস্থানের জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে।

জানা যায়, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি পেজ ও গ্রুপ খোলেন নাহিদ। এ ছাড়া বাজার প্লেস্ক বিডি ২০২০, টব বাজার ২০২০ সহ বেশ কিছু অনলাইন সাইটে তার টব বিক্রি শুরু হয়। গোল টব ১ থেকে ৬শ টাকা, স্কিয়ার ১ থেকে ১৬শ টাকা, শিকা বাটি ৫০ থেকে ৫শ টাকা, ইমুজি ৮০ থেকে ২শ টাকা করে বিক্রি হয়। নাহিদের নার্সারিতে সিলভার রাইস, এডিনিয়াম, অরকিট, বেবিটিয়াস, সাইকাস, বাশর লতা, কাঠ গোলাপ, ইনডোর প্লানসহ ৩ থেকে ৪শ গাছের চারা রয়েছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঘরের সামনের উঠানে একটি নার্সারি। এতে রয়েছে হরেক রকমের ফলজ, ঔষুধি ও ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছ। সকাল-বিকেল মানুষ আসছে নার্সারি দেখতে। ঘরের পাশে ছোট একটি চৌচালা করে বানানো হয়েছে টবের কারখানা। রয়েছে বিভিন্ন সাইজের টব বানানোর ডাইস। নিয়মিত টব বানানোর কাজ করছেন শ্রমিকরা। পাশেই চেয়ারে বসে কাজ করছে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা আর্ট করছে টবগুলোতে। ক্রেতারা যে রকমের চিত্র চাচ্ছেন তা টবে অঙ্কন করা হচ্ছে।

নাহিদ বলেন, টব বানানোর পাশাপাশি নার্সারি করার চিন্তা ছিল না। তবে টবের সাথে সাথে গাছেরও চাহিদা বাড়তে শুরু হয়। ক্রেতারা ছাদ বাগান বা রেস্টুরেন্ট সাজানোর জন্য টব নিতে এসে আমার কাছে পরামর্শ চায়তো। তাদের পরামর্শ দিতাম। তারা আমার পরামর্শে ভালো করছে তারা। তাই আমিও ভাবলাম যেহেতু জায়গা আছে, সেই জায়গায় নার্সারি করলে ভালো হবে। পরে কাজ শুরু করে দিই নার্সারির করার। বর্তমানে আমার নার্সারিতে ৪০০ প্রজাতির গাছ রয়েছে।

ফেসবুকে দেওয়ার পর বেচাকেনা কেমন হয় জানতে চায়লে নাহিদ বলেন, প্রথম দিকে আমার অনেক বাধা আসে। পরিবার ও আশপাশের লোকজন আমার সাথে ছিল না। সবাই দেখত আর আমাকে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করত। তারপরও আমি পিছপা হইনি। তবে সবসময় এই টব বিক্রি হয় না। সিজনের সময় প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি হয়। আমার নার্সারিতে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার গাছ ও চারা রয়েছে। 

আর্টের কাজ করা শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ অন্তু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকায় একটি চাকরি করতাম। এতে নিজের চলার মতো খরচ আসত। করোনায় চাকরিটা চলে যায়। পরে আমি দেশে চলে আসি। আগে থেকে বিভিন্ন আর্ট করতে আমার ভালো লাগতো। খবর পাই নাহিদ ভাই সিমেন্টের টব বানান। তাকে বললাম, টবে যদি সুন্দর করে আর্ট করা যায় তাহলে দাম ভালো পাওয়া যাবে।

তিনি তার পাইকারদের সাথে কথা বলে আমাকে আর্ট করতে বলেন। বেশ কয়েকটি টব আর্ট করি। আর্ট করা টবের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে করে আমার অস্থায়ী একটি চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যায়। এখন অনেকেই রুমের দেওয়াল আর্টের জন্য আমাকে বলেন।

নার্সারিতে ঘুরতে আসা মেহেদী হাসান যুবরাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মাঝে মধ্যেই ঘুরতে আসি এ নার্সারিতে। এখানে অনেক ধরনের গাছ রয়েছে। ছাদ কৃষির জন্য রয়েছে বিভিন্ন সাইজের টব। ঘরের সৌন্দর্যের জন্য আর্ট করা ছোট-বড় টব।

ডামুড্যা পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম রাজা ছৈয়াল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিদেশ থেকে আসার পর হাতে টাকা-পয়সা না থাকায় নাহিদ খুব ঝামেলায় ছিল। তবে হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। ছোট বেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রমী সে। নাহিদ নিজের বাড়িতেই সিমেন্টের টব তৈরি শুরু করে। পাশাপাশি ছোট একটি নার্সারিও দেয়। মাঝে মধ্যেই আমি তার নার্সারিতে যাই। ভালো লাগে আমার কাছে। সবাই যদি চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরা উদ্যোক্তা তৈরি হয় তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে। নাহিদ আমার এলাকায় একজন সফল উদ্যোক্তা। 

আরআই