ঢাকা-বরিশাল নৌপথে বিলাসবহুল লঞ্চগুলোর কেবিন সংকটের পর নতুন সমস্যায় পড়েছেন ডেকের যাত্রীরা। ঈদযাত্রায় ‘তোষক ও বিছানার চাদর পার্টি’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চের স্টাফদের পেতে রাখা তোষক ও বিছানার চাদরের কারণে সাধারণ যাত্রীরা বিছানার চাদর বিছাতে পারেন না। অনেকটা বাধ্য হয়ে স্টাফদের কাছ থেকে টিকিটের ভাড়ার চেয়ে দুই-তিনগুণ বেশি টাকা দিয়ে আসন বুঝে নিতে হচ্ছে।

যদিও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, যাত্রীদের চাহিদার কারণে তোষক বিছিয়ে দিতে হচ্ছে।

শুক্রবার (৬ মে) বিকেল ৩টা থেকে বরিশাল নদী বন্দর ঘুরে দেখা গেছে, বরিশাল-ঢাকা রুটে সরাসরি ১১টি লঞ্চ যাত্রী বহনের জন্য নোঙর করা আছে। এর মধ্যে প্রায় সবগুলো লঞ্চেই ডেকের বিভিন্ন স্থানে লেপ, তোষক ও বিছানার চাদর বিছিয়ে রেখেছেন লঞ্চের স্টাফরা।

এমভি সুরভী-৯ লঞ্চের এক স্টাফ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সব তলাতেই তোষকের ব্যবস্থা রয়েছে। একতলা-দোতলার ডেকে অনেকগুলো তোষক, চাদর ও লেপ বিছানো। এছাড়া দোতলার একটি কক্ষ পুরোপুরি তোষক বিছানো। সেখানে কমপক্ষে ২০ জন লোক যেতে পারবে। 

তিনি জানান, নিচ তলার ডেকে তোষক, বিছানার চাদর বা লেপের ভাড়া দুইশ থেকে চারশ। দোতলায় ভাড়া একটু বেশি, ৫শ করে। আর মসজিদে বা সেলুন কক্ষে যেগুলো বিছানো আছে সেগুলোর ভাড়া এক হাজার টাকা করে।

ওই স্টাফ বলেন, এই ভাড়া শুধু তোষক, বিছানার চাদর বা লেপের। লঞ্চের ভাড়া আলাদা।

এমভি কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের এক স্টাফ জানান, তোষক, চাদর বা লেপের ভাড়া নির্ধারিত নেই। এই ব্যবসা সারা বছর করতে পারি না। ঈদের কয়েকদিন করি কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। যাত্রীদের সঙ্গে দরদাম করে যে কয় টাকা পাই তাতেই দিয়ে দিই।

এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের এক স্টাফ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেতন দিয়ে আসলে স্টাফদের পোষায় না। এজন্য এসব করতে হচ্ছে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ জানে। কিন্তু তারাও চান না এসব ব্যবসা বন্ধ হোক। 

তিনি বলেন, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি দেখলে হয়তো আমারও চাকরি যাবে। কিন্তু সত্য কথা হলো, লঞ্চের লেপ, তোষক ও বিছানার চাদর, স্টাফ কেবিন- এসব বিক্রি বন্ধ হলে স্টাফদের বেতন বাড়াতে হবে। কিন্তু তা কোনো লঞ্চ মালিকই বাড়াবেন না। দুই-একটি লঞ্চ ছাড়া প্রায় সকল লঞ্চেই এই ব্যবসা সারা বছর চলে।

ঢাকাগামী যাত্রী সাইমুন বলেন, তিনটি লঞ্চ ঘুরেছি। কোনো লঞ্চেই চাদর বিছাতে পারিনি। যেখানে যাই, দেখি স্টাফরা তোষক নয়তো লেপ বা চাদর বিছিয়ে রেখেছে। ডেকের যাত্রীরাও দিন দিন সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি।

তাহমিনা নামে আরেক যাত্রী বলেন, যতক্ষণ স্টাফদের লেপ, তোষক, বিছানার চাদর বিক্রি শেষ না হয় ততক্ষণ কোনো স্থানে দাঁড়াতেও দেয় না। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সরতে বলেন। লঞ্চ মালিকরা যতই বলুক এসব ব্যবসা তারা করেন না, আসলে লঞ্চঘাটে এলে প্রকাশ্যেই দেখবেন ডেকে ডেকে লেপ-তোষক ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।

মোজাম্মেল নামে এক যাত্রী বলেন, পরিবারসহ চেষ্টা করেছিলাম কেবিনে যাওয়ার। কেবিন পাইনি। এজন্য সপরিবারে ডেকে যাওয়ার চিন্তা করে এসেছিলাম। এসে দেখি তোষক আর বিছানার চাদর পেতে রেখেছেন স্টাফরা। তারা টিকিটের ভাড়ার চেয়ে ৬শ-৭শ টাকা বেশি দাবি করছেন। আমরা লঞ্চ স্টাফ আর মালিকদের কাছে জিম্মি। প্রশাসন কী করে জানি না।

যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন লঞ্চের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।

এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের সুপারভাইজার আব্দুর রব বলেন, তোষক বা বিছানার চাদর ভাড়া দেওয়ার অনুমতি লঞ্চ কর্তৃপক্ষ দেয়নি। কিন্তু যাত্রীরা এসব ভাড়া নিতে চায়। এ জন্য কোনো কোনো স্টাফ গোপনে লেপ-তোষক ভাড়া দেয়।

এমভি কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের ব্যবস্থাপক স্বপন বলেন, আগে অনেক স্টাফ লঞ্চে তোষক ভাড়া দিত। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ এই কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমরা যাত্রীদের পরিচয় লিখে রেখে ভাড়া দিই।

বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যদি সেবার উদ্দেশ্যে এগুলো বিছিয়ে দিয়ে যাত্রীদের খুশি করে কিছু নেয় তাতে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যাত্রীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করা অনুচিত। বিষয়টি নিয়ে লঞ্চ মালিকের সাথে আমি কথা বলব।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর