লাঠিটিলায় বনকে বাঁচাতে দরকার পুরুষ হাতি
লাঠিটিলা সিলেট বিভাগের একমাত্র বন যেখানে শত বাধা উপেক্ষা করে এখনো টিকে আছে পাঁচটি বন্যহাতি। মৌলভীবাজারের জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার এক প্রান্তজুড়ে অবস্থিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। এই ফরেস্টের অধিনেই অবস্থিত লাঠিটিলা বন। লাঠিটিলায় ৫টি বন্যহাতি এখনো টিকে থাকলেও তার সবকটিই মেয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বনে পুরুষ হাতি নেই। ফলে হাতির বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে না। বংশ বৃদ্ধি না হলে এই বন থেকে হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বনে যদি অন্তত একটি পুরুষ হাতিও নিয়ে আসা যায়, তাহলে বন্যহাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, লাঠিটিলা, সমনভাগ, বড়লেখা, মাধবছড়া বিট নিয়ে বিস্তৃত সংরক্ষিত এই বনটি। মানুষের চলাচল ও বসতি করার ফলে হাতিগুলো দূরে চলে গেছে। তবে খাবারের খোঁজে এখনো লোকালয়ে আসতে দেখা যায় দল বেঁধে। ভারতের আসাম রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় তাদের বিচরণ।
লাঠিটিলা বন বিটে ৫ হাজার ৬শ ৩১ একর বনের জায়গা আছে। মৌলভীবাজারের ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সিলেট বন বিভাগের জুড়ী ফরেস্ট রেঞ্জের লাঠিটিলা পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্টের একটি অংশ। ২০১৫ সালের সর্বশেষ পরিমাপ অনুযায়ী বর্তমানে সংরক্ষিত বনটির আয়তন ৮০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে লাঠিটিলার আয়তনই ২০ বর্গ কিলোমিটার।
সরেজমিনে জুড়ীর লাঠিটিলায় গেলে কথা হয় এলাকার মানুষের সাথে। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, চার যুগ আগে ভারতের আসাম রাজ্য থেকে ছুটে আসা একদল বন্যহাতি বিচরণ করত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টে। দুই বছর আগেও পাথারিয়া বনটিতে প্রায় সারাবছর দল বেঁধে বিচরণ করত এই হাতিগুলো। মাঝে মধ্যে আসা যাওয়া করত ভারতের আসাম রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায়। পূর্বের তথ্য সূত্রে জানা যায়, তখন এই দলে ছিল মোট ৯টি হাতি, তার মধ্যে ৮টি মেয়ে ও একটি পুরুষ হাতি। দলের রাজা ছিল পুরুষ হাতিটি। উচ্চাতায় ছিলো সবার উঁচু।
ভারতের স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময় এই হাতিগুলো ছিল ভারতের এক মালিকের পোষা। হাতির মালিক মারা যাওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে হাতির দলটি। পরে মালিকের ছেলে হাতিগুলোকে ছেড়ে দিয়েছিলেন আসামের স্থানীয় এক বনে। বনটির নাম দুহালিয়া হিল কিট। তখন এই দলে ছিল মোট ৭টি হাতি। পরে সংখ্যায় দুটি বেড়েছিল এবং সেদুটি ছিল মেয়ে হাতি। তখন থেকে বুনো পরিবেশে এসে এরা বন্যহাতি হয়ে যায়। তবুও এরা ভুলে যায়নি মালিকের কথা।
প্রতিবছর এক-দুবার মালিকের বাগানবাড়ি যায় হাতিগুলো। সেখানে গেলে মালিকের ছেলে তাদেরকে আদর-আপ্যায়ন করত। চুপচাপ খেয়ে আবার চলে আসত বনে। এ রকম চলছিল বেশ কয়েক বছর। তবে জংলি পরিবেশে ধীরে ধীরে তারা বেশ হিংস্র হয়ে ওঠে। এরপরও বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু পথে তাদের হিংস্রতা বেড়ে যায়! দলের একমাত্র পুরুষ হাতিটি ছিল বেশ চঞ্চল ও রাগি। পুরুষ হাতিটি তখন থেকে আসামের বেশ কিছু জায়গায় ক্ষতি করা শুরু করে।
কথা হয় ভারতের আসান রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার পাথারকান্দি থানার ডুমাবারই এলাকার নিপেন্দ্র বিশ্বাস নিপুর সাথে। তিনি বলেন, বাড়ির পাশে আমার পাকা ধানে প্রায়ই মই দিত। এর পর থেকে এলাকার স্থানীয়রা ধান খেত ছেড়ে দেয়। তবে হাতিগুলো হাল ছাড়ল না, বসত বাড়ি, কলা বাগানে অভিযান শুরু করল। এভাবেই তাণ্ডব চালাত কাঁঠালের মৌসুমেও। পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণে চলে আসত পুরো দল। পরে কাঁঠালের মৌসুমে ফলগুলো কেটে মাঠিতে ফেলে দিতাম! কারণ পাহাড়ি এলাকায় তাদের (হাতিদের) সাথে কোনোভাবে পারতাম না। কাঁঠাল খাওয়ার জন্য এরা এসে ঘর-বাড়ি ভেঙে ফেলত।
বিজ্ঞাপন
নিপেন্দ্র বিশ্বাসের বাড়ির ঠিক উত্তর পাশে ছিল করিডোর। যে রাস্তা দিয়ে হাতি বাংলাদেশে ঢুকত। ঢুকার জন্য মোট দুটি করিডোর ছিল। একটি ভারত বাংলাদেশের মধ্যবর্তী সীমান্ত ১৩৯৬ পিলারের ঠিক বিপরীতে। আরেকটি হচ্ছে ১৩৯৫ পিলারের বিপরীতে। প্রায় এক কিলোমিটার জায়গায় কাঁটা তারের বেড়া দেয়নি হাতির জন্য। একবার বাংলাদেশে ঢোকার পর ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বেড়া দিয়েছিল তাদেরকে আর ভারতে ডুকতে দেবে না বলে। কিন্তু হাতিদেরকে আটকাতে পারেনি, বেড়া ভেঙে চলাচলের পতিবন্ধকতা দূর করে তারা।
জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৯ সালে দুটি হাতি ভারতের করিমগঞ্জ জেলার চম্পাবাড়ী এলাকায় বৈদ্যুতিক তারে শক খায়। এতে একটি হাতি ঘটনাস্থলে মারা যায়। আরেকটি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন তাদের দলে ছিলো ৭টি হাতি। এরপর আহত হাতিটিকে বন বিভাগের অধিনে চিকিৎসা করার পর পুনরায় বনে ছেড়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, একবার বনে খাদ্যসংকটে পড়ে জুড়ী উপজেলার পূর্বজুড়ী ইউনিয়নের বেলবাড়ী, কয়লারতল এলাকায় ধানখেতে নামে। পরে অসুস্থ (শক খাওয়া) ওই হাতিটি পুনরায় বনে ফিরতে ব্যর্থ হলে হাতির দল তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এরপর ২০২১ সালের আগস্ট মাসে ভারতের চম্পাবাড়ী এলাকায় সেই অসুস্থ হাতিটি মারা যায়। মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ওই এলাকার বিজয় সূত্রধর নামে একজন।
স্থানীয় পরিবেশ কর্মী খোরশেদ আলম লাঠিটিলা বনে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। তিনি বলেন, পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের লাঠিটিলা বন বিট প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য সব চেয়ে ভালো স্থান। এ জন্য হাতিগুলো এখানেই বিচরণ করত বেশি। বনের মূল ভূখণ্ডে বন বিভাগের আয়োজনে বনায়ন করার কারণে আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন জাতের গাছ ও বাঁশ কাটা পড়েছে। সে জন্য এখান থেকে বন্যহাতি বিলুপ্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে লাঠিটিলা বন বিটের কর্মকর্তা সালাউদ্দিন বলেন, গত ৬ মাস ধরে বাংলাদেশে আসছে না হাতিগুলো। বিশেষ করে ধান-কাঁঠালের সিজন ও বাঁশের করিল খাওয়ার জন্য আসত ৫টি হাতি। অন্যদিকে আমাদের জঙ্গলের চেয়ে ভারতের জঙ্গলটা বিস্তৃত বেশি। সে জন্য তারা সেখানে কিছুটা রিলাক্স ফিল করে। যেখানে মানুষ আছে সেখানে তো হাতি আসবে না।
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমাদের এলাকার মধ্যে কোনো হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তথ্যমতে লাঠিটিলায় ৫টি মেয়ে হাতি রয়েছে। এখানে একটি পুরুষ হাতি প্রয়োজন। দুবছর আগে ভারতের ওখানে দুটি পুরুষ হাতি দিয়েছিল। গত বছরই শুনেছি হাতির এই পালটাতে কোনা পুরুষ হাতি নাই। এ বিষয়ে আমি ভাবছি কীভাবে কী করা যায়। এই এলাকায় লাইসেন্স করা দু-একটা পোষা হাতিও রয়েছে। কোনোভাবে যদি তাদের মাঝে মিশ্রন হয় তাহলে বংশবৃদ্ধির আশা করা যায়। হাতিরা তিন বছরে একবার বাচ্চা দেয়।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বন্যপ্রাণীকে ঠিকিয়ে রাখতে সর্বপ্রথম তাদের আবাস্থল সংরক্ষণ জরুরি। তাদের আবাস ঠিকিয়ে রাখার জন্য বনকে প্রাকৃতিকভাবে থাকতে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত হলো, এই হাতির দলে পুরুষ হাতি নেই। কয়েক যুগ থেকে তারা নিঃসঙ্গ। সে কারণেই দলে হাতির সংখ্যা কমছে।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের আহ্বায়ক ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের জীব বৈচিত্রের কথা বললে এই হাতিগুলো সবচেয়ে বড় প্রাণী। কোনো কারণে যদি দেখা যায় হাতি বিলুপ্ত হচ্ছে তখন সন্দেহ জাগে, এত বড় প্রাণীর যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অন্য বন্যপ্রাণীর অবস্থা কী হবে! হাতি কনজারভেশনে আমাদের যথেষ্ঠ উদাসীনতা রয়েছে। এটার দায়িত্বে যারা আছেন তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকল্প নির্ভর কার্যাবলী পরিচালনা করে থাকেন।
বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ বলেন, স্থানীয় যারা আছেন তাদেরকে সচেতন করতে হবে। হাতি বা বণ্যপ্রাণী মারা যে দণ্ডনীয় অপরাধ তা মানুষকে জানাতে হবে। এই জানানোর মাধ্যমটা হচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বন বিভাগ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, লাঠিটিলার হাতিগুলো ভালোই আছে। সমস্যা একটাই, এই দলে কোনো পুরুষ হাতি নেই। পুরুষ হাতি না থাকলে তাদের স্বাভাবিক প্রজনন হবে না। ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে হাতিগুলো।
বিজ্ঞাপন
আরআই