শিক্ষাজীবনে সফলতার স্বাক্ষর রাখা নজরুল ইসলাম খসরু ভূঁইয়া দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। অন্য সহপাঠীদের মতো তারও ভালো কিছু করার প্রত্যয় ছিল। শুরুও করেছিলেন প্রস্তুতি। হঠাৎ তার সম্ভাবনাময় জীবনে বাধ সাদে মায়ের অসুস্থতা।

সাংসারিক জীবন শুরু করতে না পারলেও তার যৌবনের পুরো সময় কেটেছে মায়ের সেবা করে। ২০ বছর ধরে মায়ের পিছু ছাড়েননি একমুহূর্তের জন্যও। নিজের হাতে খাবার, গোসল, প্রাকৃতিক কাজ করানো, সেবা-শুশ্রূষা সবই করেছেন। চিকিৎসায়ও কোনো ঘাটতি রাখেননি। এখন মা-বাবা নেই। তাই বাকি সময় কাটাচ্ছেন অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবার সেবায়।

নজরুল ইসলাম খসরু ভূঁইয়ার (৫৮) প্রয়াত রহিম উদ্দিন ভূঁইয়া ও আয়েশা সিদ্দীকা দম্পতির ৪ ছেলে ও ৩ বোনের মধ্যে সবার ছোট। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের নান্দিয়া সাঙ্গুইন গ্রামে তার বাড়ি।

রোববার (৮ মে) বিশ্ব মা দিবসে নিজ বাড়িতে কথা হয় তার সঙ্গে। এ সময় তিনি মায়ের সঙ্গে কাটানো স্মৃতিচারণা করে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৯৯২ সালে তার মা অসুস্থ হয়ে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ঘরেই পড়ে ছিলেন। পরের বছর তার মায়ের অসুস্থতা আরও বেড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় হাঁটাচলা। কোনোমতে অন্যের সহযোগিতায় চলাফেরা করতেন। তবে খুব একটা বেশি সময় ধরে চলতে পারতেন না। ২০০২ সালের মাঝামাঝি ব্রেন স্ট্রোক করে একেবারেই বিছানায় পড়ে যান। পরে মাকে সুস্থ করার জন্য দেশের নামকরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করান সন্তানরা।

পরে বক্ষব্যাধি, হৃদযন্ত্র, অর্থোপেডিকস, নিউরোসায়েন্সসহ বিভিন্ন চিকিৎসককে নিয়ে একটা মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। এরপর চিকিৎসা চলতে থাকে। হাসপাতালে দুই মাস রাখার পর কিছুটা সুস্থ হলে আবারও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন।

এদিকে সংসারের কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মায়ের পর্যাপ্ত সেবা না পাওয়ার হতাশা ঝাপটে ধরে নজরুলকে। সিদ্ধান্ত নেন, তিনি নিজেকে মায়ের সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। শুরু করেন সার্বক্ষণিক মায়ের পাশে থেকে সেবা করার কাজ।

নজরুল বলেন, স্ট্রোকের রোগীদের খেতে সমস্যা হয়, আমার মায়ের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। আমার মাও খেতে পারছিলেন না। তাকে লিকুইড খাবার দিতে হয়। পরে সব ধরনের খাবারই ব্লেন্ডার করে খাওয়াতে হতো। একপর্যায়ে দেখলাম মা ভাত গিলে খেতে পারছিলেন না। তখন মায়ের খাবার হিসেবে রুটির চিন্তা করলাম। পরে বাজারের প্রায় সব ব্র্যান্ডের আটা এনে রুটি খাওয়ালাম। কিন্তু এ ধরনের রুটির আটা মায়ের খেতে কষ্ট হচ্ছিল।

মায়ের খাবারের কথা মাথায় রেখে বাড়ির পাশে নিজের কয়েক বিঘা জমিতে গড়ে তুলি কৃষি খামার। নাম দিই ‘মায়ের প্রজেক্ট’। সেখানে উৎপাদিত গমের তৈরি আটা আঠালো হয় এবং সেই গমের তৈরি রুটি মা খেতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যেবোধ করতেন।

তিনি আরও বলেন, তিন বিঘা জমিতে গম, ৪০ শতাংশ জায়গায় কলা-বাগান, ২৫ শতাংশ জায়গায় পেঁপে, এক বিঘা খেতজুড়ে পাটশাক, ১০ শতাংশ পটল, আধ বিঘা জায়গায় ঝিঙা, লালশাক, লাউশাক, শসাসহ বিভিন্ন জাতের চাষ করেছিলেন। এখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য মা-বাবার জন্য রেখে অতিরিক্ত খাবারগুলো আশপাশে গ্রামে বিছানায় পড়ে থাকা রোগীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

এর মধ্যেই ২০০৭ সালে নজরুলের বাবাও স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। মায়ের পাশাপাশি বাবার সেবাও শুরু হয় তার। এক বছর পর তার বাবা মারা যান আর ছেলের এমন সেবা পেয়ে মা বেঁচে ছিলেন পরবর্তী ২০ বছর। ২০১৬ সালের ৩১ মে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সেই মাকেও বিদায় দিতে হয় তাকে।

নজরুল ইসলাম খসরু ভূঁইয়া বলেন, মা বেঁচে থাকাকালীন ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পরে তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অক্সিজেন সিলিন্ডার আনতে গিয়ে হঠাৎ গ্রামের আশপাশে বিছানায় পড়ে থাকা (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) মানুষগুলোর কথা চিন্তা হয়। পরে ভাবি নিজের মা-বাবা নেই, তাতে কী, অন্য মা-বাবার জন্যও তো কিছু করা যায়।

এবার ওই সব অসহায় মানুষকে নিয়ে কাজ করার চিন্তা শুরু করেন। সে জন্য ইতিমধ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন পাঁচ শতাধিক সদস্যের এক স্বেচ্ছাসেবক টিম। তারা এলাকাভিত্তিক ভাগ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা রোগীদের সেবা করছেন। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করছেন নজরুল ইসলাম খসরু ভূঁইয়া।

নজরুল বলেন, মা-বাবার মৃত্যুর পর নিয়ত করেছি বাকি যে কয়দিন বেঁচে থাকি, অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবার কল্যাণ করে বেঁচে থাকতে চাই। আমার লক্ষ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে মা-বাবার খেদমতকে পৌঁছে দেওয়া। তারা যেন মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। একটা পরিবারে বাবা-মা-সন্তান মিলে একটা সুন্দর আদর্শিক পরিবার হিসেবে গড়তে চাই। সৃষ্টিকর্তার পরেই একজন সন্তানের কাছে তার মা-বাবার স্থান সবার ওপরে। আমার মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে আমি কাছে থেকে দেখেছি বৃদ্ধ বয়সে একজন অসহায়ের কত কষ্ট হয়।

ভাইদের পাশাপাশি নিজের মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের প্রাপ্ত জমি বিক্রি করেও খরচ জুগিয়েছেন নজরুল। সবকিছু করেছিলেন মায়ের মুখের হাসির জন্য। এভাবে তার মা বেঁচে ছিলেন ২০ বছর। পরবর্তীকালে তার মা মারা যান। একাকী হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন এবার মানুষের জন্য কিছু করবেন। যেখানেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত অসহায় রোগীর খবর পান, সেখানেই ছুটে যান। বৃদ্ধ মা-বাবার সেবায় সন্তানদের কাউন্সিল করানো, চিকিৎসায় সহায়তা, রোগীদের সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময়ে প্রায় পাঁচ হাজার রোগীর পাশে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় কাজ করেছেন তিনি।

তার এমন কাজের অনুপ্রেরণায় পাঁচ শতাধিক যুবক স্বেচ্ছাসেবী হয়ে নাম লিখিয়েছেন। এখন ‘মা-বাবার সেবা কেন্দ্র’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ট্রাস্টের অধীনে তারা দুই ভাই মিলে ছয় একর জমিও দান করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান নজরুল।

তিনি বলেন, বাবা ও মা আমাকে বিয়ের জন্য নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। আমি অসুস্থ বাবা ও মাকে রেখে বিয়ের জন্য রাজি হয়নি। যদি তাদের সেবায় কোনো গাফিলতি হয়, এমন কথা ভেবেই সময়টা পার করে দিয়েছি।

ছোট ভাইয়ের এমন কৃতিত্বে গর্ব করেন নজরুলের বড় ভাই মানসুরুল হক ভূইয়া। তিনি বলেন, আমরা অন্য ভাই-বোনরা বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে মা-বাবার সেবায় মনোনিবেশ করতে পারছিলাম না। এমন অবস্থায় ছোট ভাই যেভাবে বৃদ্ধ মা-বাবার সেবা করেছে, তা সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। এমন ভাইকে নিয়ে আমরাও গর্বিত।

কাওরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ বলেন, এমন কাজ মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিষয়টি ভালো করে খোঁজ নিয়ে পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বিক খোঁজখবর নেওয়া হবে।

এনএ