অনেক কিছু বদলাতে দেখেছি। শুধু বদলাননি একজন— আমার মা। মায়েরা কোনো দিনই বদলান না। আমার মা এখন যেমন আছেন, শুনেছি শৈশবেও তেমনটিই ছিলেন। স্কুলে যাওয়ার আগে মা-ই আমাদের রান্না করে দিতেন। স্কুল থেকে না ফেরা পর্যন্ত মা-ই অপেক্ষায় থাকতেন। আজ চাকরিজীবনে আছি। রোজ সকালে বের হই কর্মস্থলে। ফিরে এসে দেখি মা অপেক্ষায় আছেন ছেলের জন্য।

গতকাল রোববার (৮ মে) মা দিবসে নিজের মা অমিতা সিনহাকে (৫৫) নিয়ে ঢাকা পোস্টের কাছে এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন ছেলে সিধু সিংহ।

সিধু সিংহ পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে কর্মরত। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ধনীটিলার ছেলে সিধু বড় হয়েছেন সিলেট নগরীর মাছিমপুর মণিপুরী পাড়ায়।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের সিধু মাছিমপুরের আব্দুল হামিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সবশেষ বগুড়া মেডিকেল থেকে এমবিবিএস শেষ করেন। এরপর তিনি ৩৯তম বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন।

সিধু সিংহ তার মায়ের প্রসঙ্গে জানান, অফিস শেষে ঘরে ফিরে মায়ের কাছে থাকার যে কী অনুভূতি, তা বলে বোঝানো যাবে না।

কথা বলতে গিয়ে দুচোখ জলে ভরে ওঠে সিধু সিংহের। বলেন, মায়ের জন্যই আজ আমি এই পর্যায়ে। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। আসলে সন্তানের প্রতি মায়ের দৃষ্টি না থাকলে কোনো সন্তানই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ‘মা’ যে আমার কাছে কী ধন, বলে বোঝানো যাবে না।

সিধু আরও জানান, মায়ের কারণেই আজ আমি সেবার ব্রত নিয়ে এই পেশায় এসেছি। আমার মনে আছে আমি যেদিন প্রথম বগুড়া মেডিকেলে চান্স পেলাম, সেদিন মা আনন্দে অনেক কান্না করেছিলেন। সেদিনের স্মৃতি কোনো দিন ভোলার নয়। সরকারি মেডিকেলে সুযোগ না পেলে হয়তো আমার মতো মধ্যবিত্তের পক্ষে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়া সম্ভব হতো না। সেদিনই আমার মা আমাকে বলেছিলেন, যদি কখনো ডাক্তার হতে পারি, তাহলে যেন আজীবন অসহায় রোগীদের পাশে থাকি। মায়ের আদেশমতো রোগীদের সেবা দিই। মোটকথা আমার মায়ের কারণেই আজ আমি ডাক্তার। সন্তানদের সাফল্যের গাঁথুনি মায়ের দ্বারা হয়।

সিধু সিংহের আরও এক ভাই আছেন। তিনি সিনজন সিংহ। পড়াশোনা করছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিলেট নগরীর একটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে পড়ছেন। তিনিও অপেক্ষায় আছেন তার মায়ের স্বপ্ন পূরণের পথে। তাকে নিয়ে তার মায়ের স্বপ্ন তিনি ব্যাংকার হবেন।

কাকাডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরামহীন কাজ করে ছেলেদের মানুষ করার স্বপ্নে বিভোর অমিতা সিনহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। আমাদের অনেক স্বপ্ন থাকে। অনেক কারণে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের জীবন ফুলের বিছানা নয়। কাঁটা মাড়িয়েই আমাদের সন্তানদের বড় করেছি। তারা যখন আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে তখন আমাদের থেকে সুখী মানুষ দুনিয়ায় আর কেউ থাকে না।

তিনি আরও বলেন, আমার বড় ছেলে আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে। আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে ডাক্তার হবে কিন্তু অদম্য মেধাবী আমার ছেলে সেখানে থামেনি। ৩৯তম বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়ে আমার মুখ আরও উজ্জ্বল করেছে। সে জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ।

‘আমি আমার ছেলেকে নিজের জন্য তৈরি করিনি’ জানিয়ে তিনি বলেন, এই সমাজ আর দেশের জন্য তাকে তৈরি করেছি। আমি সব সময়ই চাইতাম ছেলে অসহায় রোগীদের সেবা করবে। তাদের পাশে থাকবে। আমার ছেলের কাছে যেমন চেয়েছি, সে তেমনি তার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এলাকায় অনেকগুলো মেডিকেল ক্যাম্প সে করেছে। নিজ এলাকায় প্রতি মাসে একবার হলেও যায়। রোগীদের সেবা দেয়। এটা যে কী আনন্দের, তা বলে বোঝানো যাবে না। সবাই আমাকে ডাক্তারের মা বলে। এটা আমার গর্ব হয়।

এনএ