সুনিপুণ হাতের স্পর্শে তৈরি হচ্ছে কারুকাজখচিত টুপি। সুই-সুতা থেকে সরছে না কারও দৃষ্টি। কেউ ব্যস্ত টুপির ওপর নকশা বুনতে; কেউবা আবার কাপড় কাটতে। দিন-রাত চলছে এমন কর্মযজ্ঞ। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। দিনের পর দিন এভাবেই একেকটি টুপি রূপ নিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শিল্পে।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাব্দী গ্রামে গেলে দেখতে পাওয়া যায় এমন দৃশ্য। এই ইউনিয়নসহ কাউনিয়া ও পার্শ্ববর্তী পীরগাছা উপজেলার কমবেশি প্রতিটি গ্রামে আছেন টুপি তৈরির কারিগর।

সংসারের কাজ সামলে অবসরে টুপিতে নকশা বোনেন নারীরা। এতে বাড়তি আয়ের মুখ দেখছেন তারা। এ কাজ করে পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। আর তাদের তৈরি এসব টুপি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ২০টি দেশে যাচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে গেল দুই বছর থমকে ছিল টুপি রপ্তানি। খুব বেশি চাহিদা না থাকায় তেমন ব্যস্ততাও ছিল না কারিগরদের। তবে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসাতে আবার বেড়েছে টুপির চাহিদা। রপ্তানিমুখী টুপি ঘিরে তিস্তা নদীবেষ্টিত কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার অন্তত ৪০ গ্রামের ২৫ হাজারের বেশি নারী এখন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে স্বামী-পরিত্যক্তা ও হতদরিদ্র ১০ থেকে ১২ হাজার নারীর মূল পেশাই এখন টুপির কাজ।

সরেজমিনে কাউনিয়ার শহীদবাগ ইউনিয়নের সাব্দি গ্রামে দেখা গেছে, সাংসারিক কাজ কিংবা রান্নাঘরেও চলছে টুপি তৈরির কাজ। এই টুপি তৈরি করে একসময়ের অভাব-অনটনে থাকা দরিদ্র নারীদের জীবনচিত্রই পাল্টে গেছে। তারা এখন স্বাবলম্বী। তাদের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। অভাব শব্দটি তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেও আগের মতো নেই হতাশার ছাপ। কিন্তু রংপুরে এই শিল্পের শুরুর গল্পটা এমন ছিল না।

কাউনিয়ার সাব্দী গ্রামে ১৯৯৮ সালে টুপির কাজ নিয়ে আসেন জহির উদ্দিন। ভোলা থেকে আসা এ আগন্তুককে তখন গ্রামের অনেকেই জায়গা দিতে রাজি হয়নি। বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে দিয়ে টুপি তৈরির শুরুটা দেখতে চেয়েছিলেন ওই বাড়ির বাসিন্দা আবোর উদ্দিন। এখন তিনি বেঁচে নেই। আবোর উদ্দিনের সেই বাসা থেকেই শুরু নারীদের সূক্ষ্ম হাতের সেলাই করা টুপির কাজ। শুরুর দিকে কয়েকজন নারী জড়িত থাকলেও ক্রমাগত তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তারপর মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো শুরু করেন। আরব দেশে এই টুপির চাহিদা বেশি থাকায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জহিরকে। বর্তমানে ওমানে তার দুটি টুপির দোকান রয়েছে।

এখন বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা নিজস্ব উদ্যোগে ছোট ছোট কারখানা দিয়েছেন। অনেকে আবার টুপি বানানোর এ ব্যবসা করছেন। এসব কর্মযজ্ঞে তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান, যা একসময়ের মঙ্গাকবলিত তিস্তাপাড়ের হতদরিদ্র হাজারো নারীকে দিয়েছে সুযোগ। গ্রামীণ জনপদে টুপিশিল্পের বিকাশ ও সুযোগ বাড়াতে রংপুর অঞ্চলের অন্য জেলার নারীরাও দিন দিন এ কাজে আগ্রহী হচ্ছেন।

কাউনিয়ার সাব্দী গ্রামের টুপির কারিগর মিনারা, কদ বানু ও সানজিদা বেগম জানান, একটি টুপির নকশা বুননসহ অন্য কাজ মিলে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। মাসে গড়ে তারা একেকজন ৪-৬টি করে টুপি তৈরি করেন। প্রতিটি টুপিতে নির্দিষ্ট নকশা ও সাইজ অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান।

কঠিন অভাব ডিঙিয়ে আসা একই উপজেলার ভুতছড়া গ্রামের রমিছা বলেন, স্বামীর টাকা দিয়্যা হামার সংসার ঠিকমতো চলে নাই। সোগসময় একটা না একটা সমস্যা নাগি আছিল। এ্যলা আল্লাহর রহমতে হামরা ভালো আছি। আগের মতো স্বামী-সন্তান নিয়্যা কষ্ট নাই। সংসারের কামের পাশাপাশি এ্যলা টুপি সেলাইয়ের কামো করোং। কোনো মাসে ৩ হাজার, ফির কোনো মাসে ২ হাজার টাকা আয় হয়।

সেখানকার খোর্দ্দ ভুতছড়া গ্রামের টুপি শ্রমিক শামসুন নাহার ও রেহেনা বেগম প্রায় ১২ বছর ধরে টুপি তৈরির কাজ করছেন। তাদের একেকজনের এখন মাসিক আয় পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা। তারা টুপির চারদিকে মোটা সুতা ঢোকানোর কাজ করেন, যাকে বলা হয় হাসু। এতে প্রতিটা টুপির জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা করে পেয়ে থাকেন।

স্থানীয়রা বলছেন, ২০০২ সালে শহীদবাগ ইউনিয়নের খোর্দ্দ ভুতছড়ার হতদরিদ্র ফরিদ উদ্দিনের স্ত্রী শহিদা বেগম এই গ্রামে প্রথম টুপি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। তার সেই তৈরি টুপি ঢাকার এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর পছন্দ হয়। তারপর থেকে শুরু হয় শহিদার বদলে যাওয়ার গল্প। তার সঙ্গে বদলাতে থাকে গ্রামের বেকার, হতদরিদ্র নারীদের জীবনগল্পও। দ্রুত সময়ের মধ্যে খোর্দ্দ ভুতছাড়াসহ আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে টুপি ও শাহিদার উত্থানকাহিনি। এভাবেই ভুতছাড়া, পার্শ্ববর্তী বল্লভবিষু, শিবু, রামচণ্ডীপুর, শাহবাজ, বেটুবাড়ি, পূর্বচাঁদঘাট, পশ্চিমচাঁদঘাট, বখসিপাড়াসহ এখন গোটা কাউনিয়া উপজেলা পরিণত হয়েছে টুপির কারখানায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে পাকিস্তানি টুপি শীর্ষস্থান দখল করে থাকলেও রংপুর অঞ্চলের দৃষ্টিনন্দন টুপি ওমান, কুয়েত, কাতার, সৌদি ও বাহরাইনসহ প্রায় ২০টি দেশে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে।

রপ্তানিযোগ্য এ শিল্পের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে শহীদবাগের সাব্দী গ্রাম থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকেই। তাদের একজন জহিরুল ইসলাম জহির। যিনি ওমান থেকে তার স্ত্রীকে নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিয়ে টুপি রপ্তানির ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। বেকার ও দুস্থ নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই টুপি শিল্প সচ্ছলতার পথ খুলে দিয়েছে বলে মনে করেন জহিরের স্ত্রী ফারজানা শারমিন।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কর্মী ও এজেন্টদের মাধ্যমে আমরা টুপি তৈরি করে নিচ্ছি। কর্মীদের বাড়ি বাড়ি সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। প্রতি পিস টুপিতে নকশা করার জন্য তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেয়ে থাকেন। প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টুপি ওমানে পাঠানো হচ্ছে। মান, আকার ও প্রকারভেদে একেকটি টুপি তৈরিতে খরচ পড়ছে ৭০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব টুপি ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

এ দিকে করোনার প্রভাবে গত দুই বছর লোকসান হলেও এ বছর তা কাটিয়ে ওঠাতে চান শতবর্ষী এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা। তাদের অনেকে মনে করছেন সরকারিভাবে সহায়তা পেলে টুপিশিল্পের আরও সম্প্রসারণ করতে পারবেন তারা। একই সঙ্গে রপ্তানি খাতে আরও বেশি বৈদেশিক আয় বাড়বে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পুঁজি সংকটে ব্যবসায় গতি ফেরাতে অনেক উদ্যোক্তা হিমশিম খাচ্ছেন।

এই শিল্পের কারিগরদের সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম মিলন। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, অল্প সুদে এই শিল্পের উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করে দিলে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। একই সঙ্গে কারিগরদেরও সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে। এটা করতে পারলে আরও বেশি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঙ্গে এই শিল্প ঘিরে ভবিষ্যতে সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে।

বেসরকারি খাতে এই শিল্পের বিকাশ ঘটলেও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার সময় আমরা এসব কারিগরের পাশে ছিলাম। ভবিষ্যতেও প্রয়োজন হলে আমরা তাদের পাশে থাকব।

এনএ