আসন্ন বাজেটে তিস্তা মহাপরিকল্পনার অর্থ বরাদ্দ না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। নিজস্ব অর্থায়নে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী।

শুক্রবার (১৩ মে) দুপুরে রংপুর নগরীর বর্ণসজ্জা নামে ছাপাখানার কার্যালয়ে তিস্তা কনভেনশন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সাফিয়ার রহমান, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ড. তুহিন ওয়াদুদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

তিস্তা সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি জানিয়ে নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা শুনে আসছি। আজ পর্যন্ত তার বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। অর্থ বরাদ্দ হয়নি। আর কদিন পরই ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হবে। মাত্র সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা আলোর মুখ দেখবে না, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। তিস্তার সাথে রংপুর অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। আমরা চীন-ভারত বুঝি না। নিজস্ব অর্থায়নে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আসন্ন বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। যদি এটি করা না হয় তাহলে অচিরেই বৃহত্তর আন্দোলন ও সংগ্রামের কর্মসূচি দেওয়া হবে।

এই রাজনীতিক অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর বসবাস রংপুরে। তারপরও বিশেষ কোনো বরাদ্দ ও ব্যবস্থা নেই। বরং রংপুরকে পিছিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের ১ শতাংশের চেয়ে কম বরাদ্দ রংপুর বিভাগের জন্য দেওয়া হয়। দেশে চলমান তিন লাখ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প চললেও রংপুর বিভাগের জন্য কোনো মেগাপ্রকল্প নেই। তিস্তা সুরক্ষায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে। অথচ তিস্তা নদীর ভাঙন-বন্যায় প্রতিবছর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার বহুগুণ বেশি।

নজরুল ইসলাম বলেন, এই মূহূর্তে সরকারের উচিত হবে, সাড়ে আট হাজার কোট টাকা ব্যয় করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তার পরিচর্যা নিশ্চিত করা। এটি হলে প্রতিবছর ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষা পাবে হাজার হাজার কোটি টাকা। রংপুরের সাথে সারাদেশের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্যেও তিস্তা সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তিস্তাপাড়ের মানুষ এক অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে দিনাতিপাত করছে। ভাঙনে, বন্যায় তাদের জীবন আজ বিপর্যস্ত। ইদানিং যুক্ত হয়েছে অসময়ের বন্যা। তিস্তাপাড়ের পাঁচ জেলায় অন্তত কোটি মানুষের জীবনে তিস্তা অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সারাদেশে যখন গড় দারিদ্র্য কমে তখনো রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যানের চেয়ে ২০১৭ সালের সরকারি পরিসংখ্যানে সেই চিত্র ফুটে উঠছে। শুধু তাই নয়, সারাদেশে যখন গড় দারিদ্র্য ২০ শতাংশ, রংপুরের গড় দারিদ্র্য তখন ৪০ শতাংশেরও বেশি। নদী ভাঙনের কারণে আজ দেশের ১০টি জেলার পাঁচটি জেলা রংপুর বিভাগে। এর মধ্যে চারটি জেলার মানুষ তিস্তার ভাঙনের কারণে প্রত্যক্ষভাবে বেশি গরিব।

এক সময়ের আশীর্বাদরূপী তিস্তা আজ সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এর প্রধানতম কারণ এ নদীর কোনো রূপ পরিচর্যা না করা। তিস্তার ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বাস্তুহীন হয়। তিস্তার বুকে বাদাম, কুমড়া, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা, ডাল, ধানসহ অনেক ধরনের ফসল চাষ হয়। কিন্তু সেই ফসল কৃষক যে ঘরে তুলতে পারবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ তিস্তাকে ঘিরেই এই অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবকা চলে। সেই তিস্তা মরে গেছে। তিস্তা যদি আরও মরে যায় তাহলে কোটি মানুষের জীবনো বিপন্ন হয়ে উঠবে। এই অঞ্চলে ৫ জন মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তিস্তা নিয়ে সংসদে জোর আওয়াজ না ওঠায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই নদী আন্দোলনের নেতা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে তিস্তা নদী সুরক্ষায় ‘মহাপরিকল্পনা’ দ্রুত বাস্তবায়ন, অভিন্ন নদী হিসেবে ভারতের সঙ্গে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন, তিস্তা নদীতে সারাবছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে জলাধার নির্মাণ করার দাবিসহ ছয়টি দাবি তুলে ধরেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। 

এ সময় তারা তিস্তার ভাঙন, বন্যা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, ভাঙনের শিকার ভূমিহীন গৃহহীনদের পুনর্বাসন, তিস্তা নদী সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত খনন, মহাপরিকল্পনায় তিস্তা নদী ও নদী তীরবর্তী কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষায় ‘কৃষক সমবায় এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকলকারখানা’ স্থাপন, তিস্তা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপ নদীগুলোর সঙ্গে পূর্বেকার সংযোগ স্থাপন এবং দখল-দূষণ মুক্তকরণ এবং নৌ চলাচল পুনরায় চালু ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি জানান।

প্রসঙ্গত, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ ২০১৫ সালে রংপুর টাউন হল মাঠে কনভেশন করেছে। তিস্তার দুইপাড়ে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার মানববন্ধন করেছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নদীর সুরক্ষার দাবিতে দীর্ঘ মানববন্ধন ছিল। তিস্তাপাড়ে স্তব্ধ কর্মসূচিসহ দুইপাড়ের ১২টি উপজেলা ও জেলায় মানববন্ধনও করেছে। 

ইতোমধ্যে ছয় দফা দাবি আদায়ে তিস্তাবেষ্টিত ক্ষতিগ্রস্ত জনপদে কয়েকশ জনসভা ও তিস্তা রক্ষার দাবিতে লক্ষাধিক মানুষের স্বাক্ষর প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরণের কর্মসূচি পালন করেছে পরিষদ। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীকাল শনিবার (১৪ মে) বেলা ১১টায় লালমনিরহাটে তিস্তা ডিগ্রি কলেজ মাঠে তিস্তা কনভেনশনের আয়োজন করেছে সংগঠনটি। কনভেনশনে তিস্তা তীরবর্তী ১২টি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা অংশগ্রহণ করবেন।  

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরআই