আড়তের এক পাশে চুপচাপ বসে আছেন পরশ মণ্ডল। খুলনার দাকোপ উপজেলা থেকে ট্রাকে করে শহরের কদমতলা ফলের আড়তে তরমুজ নিয়ে এসেছেন তিনি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। কখন তরমুজ বিক্রি হবে, বিক্রি হলেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাবেন কি না সেই চিন্তায় পরশ মণ্ডলের কপালে ভাঁজ পড়েছে। 

সৈয়দ ভান্ডার নামে একটি আড়তে বসে আছেন কৃষক অসীত রায় ও সাগর গাইন। তারা দাকোপের কৈলাশগঞ্জ থেকে তরমুজ নিয়ে এসেছেন। দুপুর পর্যন্ত অর্ধেকেরও কম তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন। তবে কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাননি।

কী কারণে তরমুজের দাম এত কমে গেল তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। তবে বিরূপ আবহাওয়া অর্থাৎ টানা বৃষ্টিপাত, সঠিক বিপণন ব্যবস্থার অভাব এবং একটু দেরিতে তরমুজ তোলার কারণে চাহিদা কমেছে বলে মনে করছেন অনেকে।

পরশ মণ্ডল, অসীত রায় আর আর সাগর গাইনের মতো অবস্থা খুলনার কদমতলা ফলের বাজারে তরমুজ নিয়ে আসা বেশিরভাগ কৃষকের। উপযুক্ত দাম না পেয়ে তাদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।

সরেজমিনে দেখা যায়, কদমতলার সর্ববৃহৎ ফলের আড়তে একের পর এক ট্রাক আসছে তরমুজ নিয়ে। প্রতিটি আড়ৎ তরমুজে সয়লাব। আগের তরমুজ বিক্রি না হওয়ায় অনেক চাষি ট্রাক থেকে নতুন করে আনা তরমুজ নামাতে পারছেন না।

চাষি-আড়ৎদার সবার বক্তব্য একটিই- হঠাৎ করে তরমুজের দাম একেবারেই পড়ে গেছে। বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। ফলে চাষিরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তারা চাষের খরচও এখন তুলতে পারছেন না।

বাজারে ৪ থেকে ৮ কেজি ওজনের তরমুজ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪ থেকে ৫ টাকায়। চাষিরা ট্রাক ভাড়া, লেবার খরচ দিয়ে প্রতি পিস তরমুজে কেবল ৫ থেকে ৭ টাকা পাচ্ছেন।

কী কারণে তরমুজের দাম এত কমে গেল তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। তবে বিরূপ আবহাওয়া অর্থাৎ টানা বৃষ্টিপাত, সঠিক বিপণন ব্যবস্থার অভাব এবং একটু দেরিতে তরমুজ তোলার কারণে চাহিদা কমেছে বলে মনে করছেন অনেকে।

দাকোপ উপজেলার খোটাখালী গ্রামের পরশ মণ্ডল বলেন, ক্ষেত থেকে তরমুজ কেটে ট্রাকে করে আড়তে নিয়ে এসেছি। আশা ছিল কিছু লাভ পাব। কিন্তু এখানে এসে দেখি তরমুজের ক্রেতাই নেই। খুচরা বিক্রেতারা কেউ তরমুজ কিনতে আড়তে আসছেন না।

দাকোপের কৈলাশগঞ্জের কৃষক অসীত রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর প্রথম চার বিঘা জমিতে তরমুজের ক্ষেত করেছি। সবমিলিয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আজ ২২ হাজার টাকা দিয়ে ট্রাক ভাড়া করে তরমুজ নিয়ে এসেছি। অর্ধেকের মতো ২১ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। লাভ তো দূরের কথা এখনো ট্রাক ভাড়াই ওঠেনি। বাকি তরমুজ বিক্রি হবে কি না সন্দেহ। ক্ষেতে যে তরমুজ আছে তা আর বাজারে আনব না, ক্ষেতেই নষ্ট হবে।

একই এালাকার সাগর গাইন বলেন, তরমুজের ক্ষেত করে গত বছর ৩০ হাজার টাকা লাভ করেছিলাম। এবারও লাভের আশায় ঋণ নিয়ে ক্ষেত করেছি। লাভ তো দূরের কথা, উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হলাম। ঋণ কীভাবে শোধ করব তা বুঝতে পারছি না।

খুলনার কদমতলা ফলের আড়তে তরমুজ কিনতে এসেছেন বগুড়ার নন্দী গ্রামের বাসিন্দা শেখ রতন। এ ফল ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে যে তরমুজ ১০-১২ হাজার টাকায় কিনেছি, এখন সেটা দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় কিনছি। আমি পাইকারিতে প্রতি পিস ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করব।

কদমতলা ফলের আড়তের বিক্রয়কর্মী গৌরঙ্গ কুন্ডু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিরূপ আবহাওয়া ও ক্রেতা সংকটের কারণে চাষিরা তরমুজে পয়সা পাচ্ছেন না।

তন্ময় ট্রেডার্স আড়তের মালিক এসএম সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, তরমুজ নিয়ে বিপদে পড়ে গেছি। বাজারে তরমুজের সরবরাহ অনেক, কিন্তু ক্রেতা নেই। সকালে ১০০ পিস তরমুজ ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেছি, যা ঈদের আগে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম। 

তিনি বলেন, এখানে প্রায় ২০০ ঘর রয়েছে। ক্রেতা নেই, অসংখ্য তরমুজ পড়ে রয়েছে সব ঘরে। বিক্রি না হওয়ায় অনেক তরমুজ নষ্ট হচ্ছে।

খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, এ বছর জেলায় ১৩ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে দাকোপে ৭ হাজার ৬২৫ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর, পাইকগাছায় ১ হাজার ৫১০ হেক্টর, কয়রায় ৮৯৫ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ৩৫০ হেক্টর, রূপসায় ৫ হেক্টর, তেরখাদায় ৩ হেক্টর ও ফুলতলা উপজেলায় এক হেক্টর এবং মেট্রো থানায় এক হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে।

চাষি-আড়ৎদার সবার বক্তব্য একটিই- হঠাৎ করে তরমুজের দাম একেবারেই পড়ে গেছে। বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। ফলে চাষিরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তারা চাষের খরচও এখন তুলতে পারছেন না।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনায় এবার তরমুজের ব্যাপক আবাদ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চাষিরা তরমুজের ভালো দাম পেয়েছেন। এখন তরমুজের দাম কিছুটা কম।

দরপতনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক জায়গায় ধান কাটার পর কিছুটা দেরিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। যে কারণে তরমুজ দেরিতে পেকেছে। এছাড়া আগে আড়ৎদাররা এসে তরমুজ কিনে নিয়ে যেত। এবার সেটা হয়নি। সঠিক বিপণন ব্যবস্থা নেই। আর গাড়ি ভাড়াও অনেক বেশি। সব মিলিয়ে শেষের দিকে এসে তরমুজের দাম পড়ে গেছে।

আরএআর/জেএস