সিরাজগঞ্জে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে আপেল-বাগান করেছেন উদ্যোক্তা বোরহান উদ্দিন। ২০১৮ সালে পরীক্ষামূলক চাষ করলেও এখন পুরোপুরি শুরু করেছেন বাণিজ্যিকভাবে। বলা হচ্ছে তিনিই এখন জেলার প্রথম আপেল চাষি।

ভারতের হিমালয় প্রদেশ থেকে প্রশিক্ষণের পর সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ১০ প্রজাতির আপেল চারা। দুই শতক জায়গা দিয়ে শুরু করলেও এখন এক একর বাগানে তার আপেলগাছের সংখ্যা এখন প্রায় ৫০০।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বরহর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা খাসচর গ্রামের আবু সাইদের ছেলে বোরহান। তিনি সাত ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ঢাকার একটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।

সরেজমিনে গ্রামের শেষ প্রান্তে মাঠের অনেকগুলো জমি পেরিয়ে গেলে দেখা যায় বোরহানের আপেল বাগান। গাছগুলোয় এই মুহূর্তে ধরতে শুরু করেছে বাহারি প্রজাতির আপেল ফল। আবার অনেক গাছেই ফুটে আছে ফুল। বাকি গাছগুলোও ফুল ও ফলের অপেক্ষায়। বাগানের সামনে কোনো সাইনবোর্ড না লাগালেও বাগানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এইচবি এ্যাপল অর্চেড’।

উদ্যোক্তা বোরহান জানান, ২০১৮ সালে তিনি প্রথমে দুই শতক জায়গার ওপরে পরীক্ষামূলকভাবে ৫০টির মতো চারা লাগিয়ে শুরু করেন। ২০১৯ সালে তিনি বাগান আরও বড় করেন। এবার এক একর জায়গার ওপর রোপণ করেন প্রায় ৫০০ আপেল চারা। এর মাঝে কিছু চারা মারা গেলে সেখানে আবার রোপণ করেন নতুন চারা। সব চারা এখন গাছে পরিণত হয়ে ফুল ও ফল আসছে।

বছরের মার্চের শেষের দিক ও এপ্রিল মাসে সাধারণত আপেলগাছে ফুল এবং এপ্রিল-মে মাসে ফল আসা শুরু করে। জুলাই-আগস্টের দিকে আপেল মোটামুটি গাছ থেকে সংগ্রহের মতো হয়। ১৫ থেকে ২০ বছর ফল দেবে বলেও জানান তিনি।

ঢাকা পোস্টকে বোরহান বলেন, আমি ২০১৮ সালে আপেল নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমে ভারতে যাই এবং এর ওপর প্রশিক্ষণ নিই। পরে তারা আমাকে চারা দেয়। সেটা নিয়ে দেশে এসে কাজ শুরু করি। যখন দেখলাম যে এটা আমাদের দেশে ফলানো সম্ভব, তখন ২০২০ সালে আবার নতুন করে চারা নিয়ে এসে এই বাগান শুরু করি। ২০২১ সালে বাগান বড় করে নতুন করে কিছু চারা রোপণ করি। এভাবেই বাগানটা তৈরি হয়ে যায়। এখন আমার বাগানে ৫০০ গাছ আছে।

আপেল চাষ করার কথা মাথায় আসার ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা যে আপেলগুলো খেয়ে থাকি, সেগুলো সাউথ আফ্রিকার অথবা ইন্ডিয়ান। কিন্তু আমাদের দেশেও তো আপেল হতে পারে। আপেল বাগান থেকে সরাসরি আপেল ছিঁড়ে খাবে সবাই, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমি এই আপেল নিয়ে কাজ শুরু করি।

আপেল সাধারণত কম তাপমাত্রার অঞ্চলে হয়ে থাকে। তাই সব আপেল আমাদের দেশে হবে না। কিছু আপেল আছে, যেগুলো উচ্চ তাপমাত্রায়ও হয়। এ রকম কিছু জাত আমরা সেখান থেকে এনে দেশে চাষ শুরু করি। এখন বুঝতে পারছি যে এটা আমাদের দেশেও সুন্দরভাবে করা সম্ভব।

যদি ভালোভাবে ম্যানেজমেন্ট করি ও সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে সুন্দরভাবে বাগান করি, অবশ্যই আমরা বাংলাদেশে সফল হব, বাণিজ্যিকভাবে আমরা ভালো কিছু করতে পারব।

এইচআরএমএন-৯৯ প্রজাতির আপেলগাছ দেখিয়ে বোরহান বলেন, সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এ ধরনের এই আপেলগুলো হয়ে থাকে। ভারতসহ যে দেশগুলোয় এই পরিমাণ তাপমাত্রা আছে, সেই দেশগুলোয় এটা হয়ে থাকে। যে কারণে এটা বাংলাদেশে খুব ভালোভাবে ফলবে।

এইচবি এ্যাপল অর্চেড বাগানে এখন এইচআরএমএন-৯৯, আন্না, ডর্চেট গোল্ডেন, টপিক সুইট, গ্রানেস স্মিথ, মাইকেল, আমেরিকান মরিসাস, ইন-সামার, সামার গ্রিন, সামার র‍্যাম্বো, রেড লাভ, সাউথ আফ্রিকার আফ্রিকান রেড এইচবি আপেল চাষ হচ্ছে।

বেবারহান বলেন, এর মধ্যে রেড লাভ আমার নিজের উদ্ভাবন করা। আমি আশা করছি আগামী বছরগুলোয় আমি এবং অন্য যারা আপেল চাষ করছেন, সবাই ভালো করবেন। আমার বাগানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুজন লোক সব সময় কাজ করেন। আপেল চাষ করার জন্য অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক থাকতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনোভাবে আপেল চাষ করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি যেহেতু এটা পাহাড়ি ফল তাই জমি নির্বাচন করাটাও খুব জরুরি। জলাবদ্ধতা তৈরি হয় এমন জমিতে আপেল চাষ করা সম্ভব নয়। জমির ভিতর দিয়ে আবার পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ সিস্টেম করে দিতে হবে।

উদ্যোক্ত বোরহানের বাগান দেখতে এসেছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। পাশাপাশি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ কাজী নজরুল ইসলাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চারা দিয়েছেন। সেখানেও তার চারা নিয়ে গবেষণা চলছে।

উদ্যোক্তা তৈরির ব্যাপারে তিনি বলেন, দেশে অনেক ধণী ব্যক্তি ও অনেক জমিওয়ালা ব্যক্তি আছেন, যারা চাইলে এটা বড় আকারে করতে পারেন। তবে আমি বলব আগে সীমিত আকারে শুরু করতে হবে। সঠিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বড় করতে হবে। এ ছাড়া আমি স্থানীয় কৃষি অফিসকেও বলেছি যদি আপনারা এর উদ্যোক্তা তৈরি করতে চান, তাহলে আমি তাদের প্রশিক্ষণ দেব। বাংলাদেশে এটি সম্ভাবনাময় ফল বলেও জানান তিনি।

উল্লাপাড়া উপজেলা উদ্ভিদ ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আজমল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বোরহানের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। আমি কয়েকবার তার বাগানে গিয়েছি। তিনি প্রথমে ছোট করে শুরু করলেও এখন বড় করেছেন। এ ছাড়া তিনি যথেষ্ট পরিমাণ আপেল চারাও বিক্রি করছেন।

নতুন চাষিদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বোরহান যেমন ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে এটা শুরু করেছেন, এখন অনেকেই চাইলে তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও চারা নিয়ে আপেল চাষ শুরু করতে পারেন।

উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুবর্ণা ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তার বাগান একাধিকবার পরিদর্শন করেছি। যেহেতু এটা ঠান্ডা আবহাওয়ার ফল, তাই আমাদের দেশে এটা কতটুকু সফলভাবে চাষ হবে, এটা এখনো পরিষ্কার নয়। তার বাগানে যেহেতু ফল আসা শুরু হয়েছে, তাই সামনে আমরা এই সম্পর্কে আরও ভালভাবে বুঝতে পারব। এ ছাড়া তাকে এগিয়ে নিতে আমরা করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবে তাকে একটি ফান্ড দিয়েছিলাম। তিনি যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের সাহায্য নিতে পারেন, আমরা এর জন্য প্রস্তুত আছি।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আ জা মু আহসান শহীদ সরকার বলেন, বাংলাদেশে যদি আপেল চাষ হয়, এটা অত্যন্ত ভালো কথা। এর জন্য আমাদের যা সহযোগিতা দরকার, আমরা করব। এ ছাড়া আমি নতুন উদ্যোক্তাদের বলব যদি আপেল চাষে সাফল্য পাওয়া যায়, তাহলে তারা এটা করতে পারেন।

এনএ