বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টয়লেটের পাইপ ভেঙে উদ্ধার করা নবজাতক পুরোপুরি সুস্থ রয়েছেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে ৯ দিনে এখন পর্যন্ত শারীরিক কোনো জটিলতা দেখা যায়নি। এদিকে নবজাতক টয়লেটে পড়ে যাওয়ার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি এক দফা তদন্তের সময় বাড়িয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে সোমবার (১৬ মে) তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারে কমিটি।

তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে সর্বস্তরে কথা বলা হয়েছে। নবজাতকের মা-বাবা, প্রসূতি ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীর স্বজন, নার্স-আয়াদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেছেন, তদন্ত প্রতিবেদন এলে বলা যাবে আসলে কী ঘটেছিল, কীভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে। এর আগে অনুমান নির্ভর কথা বলা ঠিক হবে না।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুজন চিকিৎসকের সাথে শুক্রবার (১৩ মে) বিকেলে ও রাতে কথা হয় ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের। তাদের একজন হাসপাতালের শিশু বিভাগের এবং অপরজন প্রসূতি বিভাগে কর্মরত। ওই দুইজন চিকিৎসক একমত হয়েছেন, দুর্ঘটনাবশত টয়লেটে ভূমিষ্ঠ হয়ে গেলেও নবজাতকের নাভির নাড়ি ছিড়ে যাওয়া স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। দুর্ঘটনাকালীন গর্ভপাতে শিশুটি পড়ে গেলেও শিশুটির শরীরের ওজন অনুসারে নাড়ি ছিড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আরও দুটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। 

প্রথমত নাভির নাড়ি নবজাতকের নাভির গোড়া থেকে ছিড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত জরায়ু থেকে নাভির নাড়ি আরও বেড়িয়ে এসে ঝুলে থাকবে। কিন্তু এর কোনোটিই ঘটেনি। একজন দক্ষ ধাত্রী বা চিকিৎসক যতটুকু পরিমাণের নাভির নাড়ি শিশুর শরীরে রেখে কাটেন ঠিক ততটুকুই ছিল উদ্ধার হওয়া নবজাতকের নাভিতে। এখন প্রশ্ন ওঠে সঠিকভাবে নাভিটি কেটে দিল কে? 

ওই চিকিৎসক দুজন বলেন, দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতায় নাড়ি ছিড়ে যাওয়ার ঘটনার মুখোমুখি হইনি। প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে অলৌকিক ঘটনা। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অলৌকিক বলে কোনো শব্দ সমর্থন করে না। এই দুজন চিকিৎসক তাদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

একই ধরনের কথা বলেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. এমআর তালুকদার মুজিব। তিনি বলেন, কীভাবে কী হলো এ বিষয় নিয়ে আমরাও অনেক চিন্তিত। আমার চিকিৎসক জীবনে এমন ঘটনা আগে ঘটতে দেখিনি। বিষয়টি নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির সাথে একাধিকবার বসেছি। তদন্তের সময় বাড়িয়েছি। 

তিনি আরও বলেন, উদ্ধারের পর শিশুটির নাভির সঙ্গে প্রায় দুই ইঞ্চির মতো আমব্লিক্যাল কর্ড (নাভি রজ্জু) যুক্ত ছিল। যা কেউ কাটা ছাড়া ওভাবে থাকা অসম্ভব প্রায়। এক্ষেত্রে শিশুটি ব্লিডিং হয়েও মারা যেতে পারত। আবার দুই ঘণ্টা পাইপের মধ্যে বেঁচে থাকার বিষয়টি অবিশ্বাস্য। বাচ্চাটি অপরিপক্ক হয়েছিল। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ের আগেই ভেলিভারি হওয়ায় শিশুটির ওজন মাত্র ১৩০০ গ্রাম হয়েছে। যেখানে একটি স্বাভাবিক বাচ্চার ওজন হয় প্রায় আড়াই কেজি। জন্মের পর শিশুটিকে বিশেষ সেবা ইউনিটে (স্ক্যানু) চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। এখন বাচ্চা এবং মা দুজনেই পুরো সুস্থ রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বৃহস্পতিবার তাদের রিলিজ দেওয়া হবে।

নবজাতকের মা শিল্পী বেগম বলেন, ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছিল গর্ভে আমার বাচ্চা উল্টো হয়ে রয়েছে। সিজারিয়ান ছাড়া সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে না। নার্সরা আমাকে টয়লেটে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কিছু করার ছিল না। কষ্টে বেডে আমি পায়খানা করে দিই। তা পরিস্কার করতেই আমি আমার স্বজনসহ হাসপাতালের টয়লেটে গিয়ে ট্যাপের পানি ছেড়ে দুই হাত দিয়ে উপুড় হয়ে বসি। পুরো টয়লেট রক্তে ভরে যায়। তখন আমার বাচ্চা পড়ে যায়। শিল্পী বেগম দাবি করেন, টয়লেট থেকে বাইরে বের হয়ে সবাইকে জানাই তার বাচ্চা পড়ে গেছে। তবে বাচ্চার নাভি কে কাটল সে সর্ম্পকে কিছুই বলতে পারেননি তিনি।

নবজাতকের পিতা নেয়ামত উল্লাহ আজ (রোববার) সন্ধ্যায় বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছি বাচ্চা পড়ে যাওয়ার সময়ে কী অনুভব করেছিল। তার নাড়ি কে কাটল। আমার স্ত্রী বলেছেন, ব্যাথায় কিছুই টের পাইনি। আমরা সকাল ৯টায় বরিশাল হাসপাতালে এসে ভর্তি হই। তারপর হাসপাতালের বাইরে থেকে কিছু পরীক্ষা করাতে বলে। আমার স্ত্রী অনেক অসুস্থ ছিলেন। তারপরও কষ্ট করে বাইরের ক্লিনিকে নিয়ে ৭ হাজার টাকার পরীক্ষা করাই। স্বরূপকাঠি থেকে ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, গর্ভের সন্তান ভালো অবস্থানে নেই। এ জন্য বরিশাল নিয়ে আসতে বলেন। জরুরি নিয়ে আসার পর এখানে সন্ধ্যা ৬টায় সিজারিয়ানের জন্য সময় দেন। আমি ওষুধ নিয়ে ফিরে এসে ওয়ার্ডে ভিড় থেকে বুঝেছিলাম বাচ্চার মা হয়তো মারা গেছেন।

হাসপাতালের বেডে রোগী পায়খানা করে দিয়েছেন অথচ নার্স বা আয়ারা সহায়তায় এগিয়ে আসেননি বলে জানিয়েছেন প্রসূতি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরেক রোগীর স্বজন রবিউল ইসলাম। তিনি জানান, হাসপাতালে নিয়ে আসার সময়েই রোগীর (শিল্পী বেগম) অবস্থা খারাপ ছিল। তাকে বেডে শোয়ানোর পর তার স্বামীকে দেখেছি ছুটোছুটি করতে। কিন্তু ওয়ার্ডে দায়িত্বরত নার্স বা আয়ারা তেমন গুরুত্ব দেননি। 

এমনকি রোগী যখন বলেছেন, সে বেডে পায়খানা করে দিয়েছেন তখনো নার্স ও আয়ারা সহায়তায় এগিয়ে আসেননি। যদিও এমন অভিযোগের বিষয়ে নবজাতকের পিতা নেয়ামত উল্লাহ বলেন, সরকারি হাসপাতালে যেমন চিকিৎসা হয় আমার স্ত্রী-সন্তানও তেমন চিকিৎসা পাচ্ছেন। কেমন চিকিৎসা পাওয়ার কথা তা বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। কিন্তু আমার সন্তান ও স্ত্রী এখানে চিকিৎসাধীন। আমার এই মুহূর্তে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

প্রসূতি ওয়ার্ডের অফিস সহায়ক জেসমিন আক্তার বলেন, ওই রোগী (শিল্পী বেগম) টয়লেটে যাবেন তা আমাদের বলেননি। আমরা শুনতে পাই এক রোগীর বাচ্চা টয়লেটে পড়ে গেছে। তখন ছুটে গিয়ে টয়লেটে কান পেতে কান্না শুনতে পাই। তখনো ওই শিশুর মাকে টয়লেটের ওখানে দেখিনি। তাকে খুঁজে বের করেছি ওয়ার্ডের বেড থেকে।

ওই রোগী খুব বেশি অসুস্থ ছিলেন না। তাকে আমরা জিজ্ঞেস করেছি কেন তিনি টয়লেটে গিয়েছিলেন, এর কোনো জবাব আমাদের দেননি। তাকে নিয়ে যে মুরুব্বি টয়লেটে গিয়েছিলেন তিনিও কোনো কথার জবাব দেননি। বাচ্চা পড়ে যাওয়র পর তার মা এবং সাথে থাকা মুরুব্বি কোনো কান্নাও করেনি। কিন্তু বাচ্চার বাবা এসে কান্না করেন। তার বাবা না থাকলে বাচ্চা উদ্ধার করা হতো না।

জেসমিন আরও বলেন, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম অবৈধ সন্তান। সবাই অবাক হয়েছি কেন তার মা এমন আচরণ করছেন। ভেবেছিলাম, প্রথমে মেয়ে এবং তারপরও মেয়ে হয়েছে এটা দেখে ফেলে দিয়েছে। বাচ্চাটিকে যখন দোতলার পাইপ ভেঙে উদ্ধার করা হলো তখন আমিই প্রথম কোলে নিয়েছি। তখন বাচ্চার শরীরে চার আঙ্গুল পরিমাপে নাভির নাড়ি ছিল।

প্রসূতি ওয়ার্ডের ক্লিনার সাফিয়া বলেন, রোগী ও তার সাথে যে মহিলা ছিলেন তাদের আমি বকা দিয়েছি যে কেন টয়লেটে বাচ্চা পড়ে যাওয়ার পরও ট্যাপের পানি ছেড়েছে। পানি না ছাড়লে বাচ্চা পাইপের মধ্যে যেত না। আমি টয়লেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েও বাচ্চা পাচ্ছিলাম না। অথচ টয়লেটে কোনো রক্তের দাগও ছিল না। সকল রক্ত ধুয়ে ওই রোগী ও তার সাথের মুরুব্বি বেরিয়ে গিয়ে বেডে শুয়ে কান্না করেন। আমরা রোগীকে নিয়ে নার্সের মাধ্যমে তার গর্ভে থাকা নাড়ি বেড় করি। উদ্ধারে অংশ নেওয়া ট্রলিম্যান আব্দুল জলিল বলেন, শিশুটিকে উদ্ধারের সময়ে তার নাভির সাথে পরিমানমতই নাড়ি ছিল।

গাইনি ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. খুরশিদ জাহান বলেন, ওই নারীর গর্ভের সন্তান ছিল অপরিণত। সাধারণত ৩৮ সপ্তাহে প্রসব হয়। কিন্তু তার সন্তান ছিল ৩২ সপ্তাহের। প্রসব যন্ত্রণা উঠলে ১০/১২ ঘণ্টার মধ্যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। অপরিণত হলে দুই ঘণ্টার মধ্যে প্রসব করতে পারেন। নাভির নাড়ি ছিড়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। ওদিকে ঘটনার দিন বিকেলে প্রসূতি ওয়ার্ডে দায়িত্বপালনকারী কোনো নার্স এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

প্রসঙ্গত, শনিবার (৭ মে) বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে এক নারীর সন্তান টয়লেটের ভেতরে সন্তান প্রসব হয়। পরে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় দোতলার পাইপ কেটে জীবন্ত উদ্ধার করা হয় নবজাতককে। 

আরআই