মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন রকম পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে র‍্যাফল ড্রর টিকিট। লোভে পড়ে গ্রামের নিরীহ মানুষ কিনছে এসব লটারি। মেলার আয়োজক ও র‌্যাফল ড্র-সংশ্লিষ্টরা এভাবে প্রতিদিন মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

সোমবার (১৬ মে) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চাঁপাইগাছী এলাকায় গ্রামীণ মেলা এলাকা এসব দৃশ্য দেখা যায়। এর আগে শনিবার (১৪ মে) সকাল থেকে শুরু হয়েছে এ মেলা।

এদিকে আয়োজক কমিটির এসব লোভনীয় প্রস্তাবে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এসব কারণে এলাকায় চুরি ও অন্যায়-অত্যাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।

তবে প্রশাসন গ্রামীণ মেলার অনুমোদন দিলেও লটারি বা র‌্যাফল ড্রয়ের অনুমোদন দেয়নি। অবৈধ কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানায় প্রশাসন।

গতকাল রোববার রাতে জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চাঁপাইগাছী এলাকায় দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী চাঁপাইগাছী ‘গাজী কালু চম্পাবতী’র মেলা বসেছে। মেলার পেছনের দিকে র‌্যাফল ড্রয়ের মঞ্চে সাজিয়ে রাখা হয়েছে টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেলসহ নানা রকম পুরস্কার। মাইকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এই মঞ্চের সামনেই টেবিল-চেয়ার পেতে লটারি বিক্রি করছেন একাধিক লটারি বিক্রেতা। এখান থেকে লটারি কিনছে শিশুসহ অনেকেই। মেলার প্রবেশমুখের অদূরে চারদিক টিন দিয়ে ঘিরে যাত্রা মঞ্চও তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে যদুবয়রা জয়বাংলা বাজারের চা বিক্রেতা হিরোন শেখ বলেন, রোববার ৫টা টিকিট কিনে একটাও পাইনি। আজ সোমবার কিনেছি ১০টা। যত দিন মেলা চলবে, তত দিন লটারি খেলা চলবে। প্রতিদিনই কিনব বলে ভাবছি।

চৌরঙ্গী বাজার এলাকায় কথা হয় ভ্যানচালক আজমলের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটা মোটরসাইকেলের খুব শখ। কেনার টাকা নেই। তাই প্রতিদিন ৫-১০টা করে লটারি কিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লটারি বিক্রেতা ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘জান ভাই’ নামের এক ব্যক্তি এই লটারি কোম্পানির মালিক। যেখানেই এসব মেলা হয়, সেখানকার আয়োজকরা এক চুক্তির মাধ্যমে লটারি কোম্পানিকে ডেকে নিয়ে যায়। র‌্যাফল ড্রয়ের লটারি বিক্রির টাকা মেলার আয়োজক ও লটারি কোম্পানি ভাগাভাগি করে নেয়।

জানা যায়, চাঁপাইগাছী গাজী কালু চম্পাবতীর মেলায় এবার ১৩৩ জন লটারি বিক্রি করছেন। তাদের প্রতিজনকে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি ও ২৭০ টাকা খাবার খরচ এবং ভ্যান ভাড়া বাবদ ৭০০ টাকা দেওয়া হয়। প্রত্যেক বিক্রেতার হাজিরাসহ ভ্যান বা যানবাহন ও মাইক ভাড়া মিলিয়ে প্রত্যেকের ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা করে খরচ হয়। তাদের প্রতিটি ভ্যান বা যানবাহন থেকে দৈনিক ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার লটারি বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ এর চেয়েও বেশি টাকার লটারি বিক্রি করেন।

মেলা কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মিজান বলেন, আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই মেলা চালাচ্ছি। কিন্তু মেলায় লটারি অবৈধ, এটা কেন চালান, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লটারি চালানোর ব্যাপারে আমাদের হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। ডিসি অফিস থেকে আমাদের আনঅফিশিয়াল অনুমোদন দিয়েছে।

জগন্নাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আজম হান্নান বলেন, মেলার নামে চলছে অবৈধ লটারি ও জুয়া। অশ্লীল নৃত্যের প্রস্তুতি চলছে। করোনাকাল কাটিয়ে মাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। দ্রুত এসব বন্ধ করা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজন্ম আরও ক্ষতির শিকার হবে। যুবসমাজ নষ্ট হবে। এলাকায় চুরিচামারি বাড়বে।

এ বিষয়ে জানতে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল বাকী বাদশাকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়। তার ফোন বন্ধ থাকায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসন দেখছে। কিন্তু লটারি খেলা অবৈধ। তবে র‍্যাফল ড্র চালানো যাবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মন্ডল বলেন, অনুমতির জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছে কমিটি। সেখানে কী কী উল্লেখ আছে, তা জানা নেই। কাগজপত্রাদি হাতে পেলে জানা যাবে। লটারির বিষয়টি দেখা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম বলেন, তাদের গ্রামীণ মেলা করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। র‌্যাফল ড্র চালানোর কোনো অনুমোদন নেই। বিষয়টা আমি দেখছি। অবৈধভাবে কোনো কিছু করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজু আহমেদ/এনএ