‌‘মেলা দিন (দীর্ঘ দিন) ধরি ব্রিজের কাম বন্ধ আছে। ঠিকাদারের লোকজন কায়ো আইসে না। কাউন্সিলরোক কয়াও কোনো কামো হওচে না। ব্রিজের বাকি কাম কোনা শ্যাষ হইতে আর কত বছর নাগবে, তাক আল্লায় ভালো জানে। হামার এই ব্রিজের পরে কাম শুরু করি অন্য এলাকার ব্রিজের কাম শ্যাষে গাড়ি-ঘোড়া চলোছে। আর হামরা আড়াই বছর ধরি কষ্ট করোছি। অথচ মেয়র-কাউন্সিলর হামারে ওয়ার্ডের লোক, তাও ব্রিজের কাম শ্যাষ হয় না।’

মোটরসাইকেলসহ ভারী যানবাহন নিয়ে ব্রিজ পারাপার না হতে পারার আক্ষেপ থেকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন শাহিন মিয়া। তিনি থাকেন রংপুর নগরের ২১ নং ওয়ার্ডের নিউ সেনপাড়ার করণজাই রোড এলাকায়। পেশায় একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

শাহিন মিয়া জানান, রংপুর নগরের যানজট নিরসনে বিকল্প সড়কগুলোর মধ্যে করণজাই রোড একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এই সড়ক হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টি, শাপলা চত্বর, নিউ আদর্শপাড়া, এরশাদ মোড়, কামারপাড়া ঢাকা কোচস্ট্যান্ড, গ্রান্ড হোটেল মোড়সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় সহজেই যাতায়াত করা যায়। কিন্তু গেল আড়াই বছর করণজাই রোড ঘেঁষা শ্যামাসুন্দরী ক্যানেলের ওপর নির্মাণাধীন ব্রিজের কাজ শেষ না হওয়ায় ভারী কোনো যানবাহন চলাচল করছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্রিজের অনেক কাজ এখনো অসমাপ্ত রয়েছে। দুই পাশের সংযোগ সড়কের কিছু কাজ হয়নি। যতটুকু কাজ হয়েছে, তাতে কষ্ট করে হেঁটে ব্রিজ পারাপার সম্ভব। তবে এর জন্য রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ নড়বড়ে ইটের অস্থায়ী সিঁড়ি। দীর্ঘ দিনে নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় আশপাশের এলাকার শত শত মানুষ এখন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। আর এতে শাহিন মিয়ার মতো সাধারণ মানুষরা পড়ছেন চরম দুর্ভোগে।

স্থানীয়রা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে কষ্ট করে ব্রিজ পারাপার হলেও বর্ষাকালে ভোগান্তি বেড়ে যায়। অনেক সময় শ্যামাসুন্দরী ক্যানেলের পানি উপচে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পুরাতন ব্রিজ থাকার সময় বন্যা ও বর্ষা মৌসুমে বেশ কয়েকবার সড়কটি পানিতে তলিয়ে ছিল। ২০১৯ সালে এই ব্রিজের আগের ভঙ্গুর অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে নতুন করে ব্রিজ নির্মাণকাজ চলছে। কিন্তু কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। বরং বিভিন্ন অজুহাতে কয়েক মাস ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

এই ব্রিজের পাশেই থাকেন আব্দুল জলিল। হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার প্রবীণ এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। পান চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে আব্দুল জলিল বলেন, শুনেছি এক বছরেরও কম সময়ে ব্রিজের নির্মাণকাজ শেষ হবে। কিন্তু এখন তো আড়াই বছরেও কাজ শেষ হচ্ছে না। এটা আশপাশের এলাকার মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকে দায় সাড়াভাবে কাজ করছে। ব্রিজের কাজ শেষ না হওয়াতে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও থ্রি-হুইলারসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। 

করণজাই রোডে নির্মাণাধীন ব্রিজের পাশে বাড়ি শারমিন আক্তার মিতুর। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এই নারী সংগঠক বলেন, ব্রিজের কাজ শেষ না হওয়ায় ড্রেনের পানি নিষ্কাশনে মাঝেমধ্যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। শ্যামাসুন্দরী ক্যানেলের পানি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে পানির প্রবাহ ঠিকমতো না হওয়াতে ময়লা আবর্জনার স্তূপে ভরাট হচ্ছে ক্যানেলের আশপাশ। যদি টানা দুই-তিন দিন বৃষ্টি হয়, তাহলে পুরো করণজাই রোড পানিতে ডুবে যাবে।

তিনি আরও বলেন, করণজাই রোডের এই ব্রিজ হয়ে নিউ সেনপাড়ার আশপাশের বেশ কয়েকটি স্কুল ও কলেজের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যাতায়াত করে। কিন্তু এখন ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় অনেক দূর ঘুরে তাদের যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তি বাড়ার সঙ্গে বেশি সময় অপচয় হচ্ছে। আমরা চাই দ্রুত এই ব্রিজের নির্মাণকাজ শেষ হোক।  

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, বিভিন্ন সড়কের পুনর্বাসন ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ভারতীয় অর্থায়নে ২০১৯ সালের শেষ দিকে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি ব্রিজের পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে শ্যামাসুন্দরী ক্যানেলের ওপর নিউ সেনপাড়ার করণজাই রোড ব্রিজ, মন্ডলপাড়া ও নিউ ইঞ্জিনিয়ারপাড়ার ব্রিজ এবং ইছামতি ক্যানেলের ওপর রথবাড়ী ব্রিজ রয়েছে। ইতোমধ্যে অন্য তিনটি ব্রিজের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, করণজাই রোডের ব্রিজটিতে ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮২ হাজার ২৬৯ টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে। এছাড়া নিউ ইঞ্জিনিয়ারপাড়া ব্রিজের জন্য বরাদ্দ ১ কোটি ৬৫ লাখ ৪৯ হাজার ২৮০ টাকা, রথবাড়ী ব্রিজে ১ কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার ১২৬ টাকা এবং মন্ডলপাড়ার ব্রিজটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার ০.৯৬ (পয়সা) টাকা। সব মিলিয়ে চার ব্রিজের পুনর্নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ৭ কোটি ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৬৭৫ টাকা ৯৬ পয়সা।

রসিকের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহাবুবার রহমান মঞ্জু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বহুবার ঠিকাদারকে কাজ করার জন্য বলেছি। সিটি মেয়র নিজেও বিষয়টি অবগত রয়েছেন। কিন্তু রড-সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্রিজের নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছে। যে কাজ ছয় মাসের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল, এখন তা আড়াই বছরেও শেষ হচ্ছে না। জনদুর্ভোগ কমাতে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করা জরুরি বলে তিনি নিজেও দাবি করেন।

এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেলাল কন্সট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী মো. রকি ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকা দেওয়ার মেয়াদ না থাকলেও কাজের মেয়াদ থাকবে কী করে? ব্রিজটি ভারতীয় অর্থায়নে নির্মাণ শুরু করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৬৫ লাখ টাকা পেয়েছি। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। নিজের টাকা দিয়ে তো কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। তারপরও আমি চেষ্টা করছি। ব্রিজের সংযোগ সড়কের দুই পাশে মাটি ফেলানোসহ বাকি কাজ শেষ হলেই এটি চলাচলের উপযোগী হবে।  

রসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী আজম আলী জানান, ভারতীয় অর্থায়নে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি ব্রিজের পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে তিনটি ব্রিজের নির্মাণ পুরোপুরি শেষ হওয়াতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। এখন শুধু করণজাই রোডের ব্রিজটির দুই পাশের রেলিংয়ের কাজ এবং সংযোগ সড়কের কিছু কাজ বাকি রয়েছে। আশা করছি আগামী মাসের ৩০ জুনের মধ্যে পুনর্নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে।

প্রসঙ্গত, ‘বিভিন্ন সড়কের পুনর্বাসন ও উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার বিভিন্ন রাস্তা ও ব্রিজের জন্য ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। এর মধ্যে আড়াই কোটি টাকা পেয়েছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ।  এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও চুক্তি অনুযায়ী এখনো করণজাই রোডসহ অন্যান্য ব্রিজের নির্মাণ শেষ হয়নি।

এসপি