ভারী কাজের জন্য দরকার শক্তির। রিকশার প্যাডেল ঘোরানোও সে রকম শক্তিমত্তার কাজ। কিন্তু হাড়-জিরজিরে শরীরে রিকশার প্যাডেল ঘোরানোর মতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে রণজিৎ ঘোষকে (৯৮)। তবে তাতেও তার হতভাগ্য, বৃদ্ধ হওয়ায় অধিকাংশ যাত্রী তার রিকশায় উঠতে চায় না। ফলে কাকুতি-মিনতি করে কিছু যাত্রীকে পার করেন।

জীবনসায়াহ্নে এসে আর কোনো উপায়ও নেই প্রায় শতবর্ষী রণজিতের। তাই রিকশা চালিয়ে জোগাড় করেন তিন বেলার আহার। আবার কোনোরকম খাবারের ব্যবস্থা হলেও নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। তাই দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে ফুটপাতেই রাত কাটে তার।

মঙ্গলবার রাত থেকে তার এমন জীবনসংগ্রামের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

রণজিৎ ঘোষের আদি বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জামালপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। একসময় হোটেলে বাবুর্চির কাজ করলেও এখন আর সেসব কাজে ঠাঁই পান না। তাই উপায় না পেয়ে রিকশা চালান।

স্বজন বলতে তার একমাত্র মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। সারা দিন রিকশা চালিয়ে রাতে যশোর শহরের চৌরাস্তার ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (এনএলআই টাওয়ার) ভবনের নিচে ফুটপাতে ঘুমান।

কথা হয় রণজিতের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, চার বছর বয়েসে মা মরে গেছে। সৎমার গালিগালাজ শুনিচি ম্যালা। দশ বছর বয়সে এই যশোরে আইচি। বিভিন্ন হোটেলের বাবুর্চির কাজ করিছি। সৎমারে আড়াল করে বাবা যশোরে আসে টুকটাক খোঁজখবর নিত। দেখাশোনা করে আমারে বিয়ে দিয়ার কয়দিন পরেই বাবা মরে গ্যালো।

হিন্দুস্তান থেকে পাকিস্তান হওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী রণজিৎ। এ প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তান হওয়ার এক বছর পরে আমার ৩ ছেলে মরে গ্যাচে ডায়রিয়ায়। ওদের বয়স তখন ৫ বছরের কম। একটা মেয়ে ছিল। এখন বেঁচে আছে কি না জানিনে। মেয়েরে বিয়ে দিছিলাম। বিয়ের পরে ওর একটা ছেলে হলো। দেড় মাস পরে বাচ্চাটকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসল মেয়ে। খুব কষ্টে মেয়ের নামে একটা বাড়িও কিনিছিলাম আকবরের মোড়ে (যশোর শহরের একটি জায়গা)। শেষে মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গ্যাছে, তার আর খোঁজ পাইনে।

তিনি বলেন, ১১ বছর আগে আমার স্ত্রী মরে গেছে। মেয়ের রেখে যাওয়া দেড় মাসের ছেলেকে বড় করলাম, বিয়ে দিলাম। সেও তার স্ত্রী-সংসার নিয়ে চলে গ্যাছে। এখন আমার দুনিয়ায় এই রিকশা ছাড়া আর আপন বলতে কেউ নেই।

দৈনিক আয়ের বিষয়ে রণজিৎ বলেন, কোনো কোনো দিন ৬০ টাকা, ৮০ টাকা, ১০০ টাকা বা ১৫০ টাকা আয় হয়। আমি বৃদ্ধ, মানুষ রিকশায় উঠতে চায় না। হাত-পা ধরে কয়জন যাত্রী আনি, সে আয় দিয়ে হোটেলে কোনো রকম দুবেলা-দুমুঠো খাই দিন পার করি।

বাড়িঘর হারানোর পরে এক হাজার টাকার ভাড়া বাসায় একাই থাকতাম। রোজগার ভালো হয় না; তাই ভাড়া করা বাসা ছেড়ে এখন ফুটপাতে থাকি। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার আক্ষেপ তুলে ধরে রণজিৎ বলেন, কত নিতার কাছে গিলাম। সবাই ফিরোয়ে দেচে। লাগবে না আইডি কাড। কী হবে এখন আর আইডি কাড দিয়ে?

যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বজন সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার দাস বলেন, শতবর্ষী রণজিৎ কুমারের জীবনসংগ্রাম যেকোনো হৃদয়বান মানুষকে স্পর্শ করবে। এ মানুষটির সংগ্রামের গল্পও আমাকে অশ্রসিক্ত করেছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার জীবনের গল্প উঠে এসেছে। তার সহায়তায় বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

জাহিদ হাসান/এনএ