ধর্ষণের অভিযোগ উঠা বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কেফায়েত হোসেন রনিকে নির্দোষ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর। ফেসবুক লাইভে এসে একই দাবি করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ।

মঙ্গলবার (১৮ মে) দুপুরে বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন একেএম জাহাঙ্গীর এবং বিকেল পৌনে ৪টার দিকে নিজের ফেসবুক পেজে লাইভ করেন সাদিক আব্দুল্লাহ।

তবে এর আগে দুপুর ১২টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে ‘ধর্ষণের শিকার’ ওই তরুণী ১২ মিনিট ২৫ সেকেন্ড কথা বলে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী এবং মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সহায়তা চান। 

ওই তরুণী দাবি করেন- মামলা দায়েরের পর থেকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। 

তিনি বলেন, কেফায়েত হোসেন রনি তার ক্ষমতা ও টাকা দিয়ে আমাকে হয়রানি করছে। আমি আমার বাড়িতে থাকতে পারছি না। একজন ধর্ষিত নারী হয়ে যদি বিচার না পাই, বাংলাদেশের কোনো নারী বিচার পাবে না। সে আসামি হয়েও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই। আমি আমার মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর কাছে বিচার চাই। পিবিআইয়ের মাধ্যমে সঠিত তদন্ত করা হোক। আমাকে মারধর করা হয়েছে, আমার মোবাইল নিয়েছে। তিনি ডিএনএ টেস্ট করানোর দাবি জানান এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার দাবি জানিয়ে কান্নাকাটি করেন।

এদিকে দুপুরে সাড়ে ১২টার দিকে বরিশাল প্রেসক্লাবে ধর্ষণ মামলার আসামি কাউন্সিলর কেফায়েত হোসেন রনির পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে একেএম জাহাঙ্গীর দাবি করেন, বিভিন্ন এজেন্সেরি মাধ্যমে ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে আমরা প্রাথমিক তদন্ত করেছি। কাউনিয়া থানা, র‌্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করিয়েছি। তারা বলেছেন, এই ধরনের অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পাননি।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সোমবার (১৬ মে) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে কেফায়েত হোসেন রনির বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা ও ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ। রনি যৌথ পরিবার নিয়ে পলাশপুর বৌবাজার সংলগ্ন দোতলা ভবনে বসবাস করেন। পুরো বাড়িতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। অথচ আদালতে দায়ের করা অভিযোগে ওই নারী উল্লেখ করেছেন কাউন্সিলর বাড়িতে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করেছে। এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃত সত্য হলো, বিগত রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি (০১৯৬...৭০) নম্বর থেকে কাউন্সিলরের কাছে ফোন আসে। অপরপ্রান্ত থেকে এক নারী জানান, সেই নারীর বান্ধবী কাউন্সিলরকে বিয়ে করতে চান। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে হয়রানি শুরু করেন। এ বিষয়টি সিটি করপোরেশনের মেয়র ও র‌্যাব-৮ এর অধিনায়ককে জানানো হয়। একপর্যায়ে ১২ মে কাউনিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রনি। 

অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ধর্ষণের অভিযোগ দায়েরকারী নারীর বাসা ১৪ নং ওয়ার্ডে। আদালতে কেফায়েত হোসেন রনির বিরুদ্ধে যেদিন অভিযোগ দিয়েছে, সেই রাত ১১টার দিকে অভিযোগকারী ও তার মা কাউন্সিলরের বাসার সামনে ঘোরাফেরা করেন। কাউন্সিলর রনি বিষয়টি দ্রুত থানায় অবহিত করে পুলিশের সহায়তায় তাদের সরিয়ে দেন। ১৭ মে তারা কোতোয়ালি থানায় গিয়ে হুমকির অভিযোগ দেন। এই পুরো ঘটনাই একটি ষড়যন্ত্রের অংশ।

মামলার আসামিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সংবাদ সম্মেলন করা তদন্ত কাজে প্রভাব বিস্তার কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, আমরা আইনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই এই সংবাদ সম্মেলন করছি। কোনো তদন্ত কাজে প্রভাব বিস্তার করছি না।

সংবাদ সম্মেলনে জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও প্যানেল মেয়র অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন, ধর্ষণ মামলার আসামি ও ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কেয়ায়েত হোসেন রনি, মহানগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জিয়াউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বুঝেশুনে সাংবাদিকদের লেখার আহ্বান মেয়রের

এদিকে বিকেল ৪টার দিকে ১০ মিনিট ১৬ সেকেন্ডর ফেসবুক লাইভে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেন, আমার পরিষদের সবচেয়ে ইয়ং, আনমেরিড, দেখতে সুন্দর জনপ্রতিনিধি কেফায়েত হোসেন রনি। তাকে নিয়ে একটি অভিযোগের বিষয়ে আপনারা  জেনেছেন। আমার কথা হলো, বরিশালে অন্যায়কে আমরা কখনো প্রশ্রয় দেইনি। ওয়ার্ডে কেফায়েত হোসেন রনির অবস্থান খুব ভালো। গত নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী থাকলেও কেফায়েত হোসেন রনি কিন্তু স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। তার পরিবার আওয়ামী লীগ পরিবার। এজন্য ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছে তাকে। এই বিষয়টি নিয়ে রনি আমার কাছে এসেছিল। আমি র‌্যাবের অধিনায়ক ও থানায় কথা বলে থানায় জিডি করিয়েছি। জিডি করার পরই কিন্তু আদালতে গিয়ে মামলাটি করেছে। আমার কথা হচ্ছে অপরাধ যে করবে সেই শাস্তি পাবে। একজন রনির জন্য আমার দল, আমার নেত্রী, আমার পরিবারের ঐতিহ্যের গায়ে নিশ্চয়ই আমি দাগ লাগাবো না। 

মেয়র বলেন, আমার কথা হচ্ছে সাংবাদিকরা যেভাবে লিখছে, সে যদি প্রমাণিত হয় জড়িত না, তাহলে এই ছেলেটার অপরাধ কি? মিডিয়ার মাধ্যমে যেভাবে ছড়ানো হয়েছে, প্রতিটি পত্রিকায় নাজেহাল....ছেলেটি অন্যায় যদি করে তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু যে আমার কাছে আসে তাকে নিয়েই ষড়যন্ত্র হয়। ওকে নিয়েও ষড়যন্ত্র হয়েছে কিনা সেটি বিবেচনা করার বিষয়। কেফায়েত হোসেন রনির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার একটিও প্রমাণিত হয়নি। 

মেয়র বলেন, মামলাটি যে আইনজীবী করেছেন তার খতিয়ে দেখা উচিত। বরিশালের যত বিকৃত বা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা তা তিনি করেন। তার কাছে কেন মানুষ যায় বুঝি না। সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানাই- বুঝেশুনে সত্য কথা লিখুন। হেয় প্রতিপন্ন করা আপনাদের কাজ না। আপনারা সমাজের বিবেক।

বাদীপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য

বাদীপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান বলেন, ওই তরুণী কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দিয়েছেন তা এখনো তদন্তাধীন। তদন্তে বাদীর বিরুদ্ধেও যেতে পারে আবার অভিযুক্ত কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেও যেতে পারে। কিন্তু তার আগেই একটি আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর, দলীয় নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলন করলে তদন্তকাজে চাপ সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে বিচার পাওয়ার অধিকার সকলেরই আছে। মামলা হলেই তিনি দোষী হন না। কিন্তু তদন্তে এভাবে চাপ সৃষ্টি করা সঠিক কাজ নয়।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার (১৬ মে) বরিশাল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কেফায়েত হোসেন রনির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেন এইচএসসি পাস করা এক তরুণী। পরে আদালতের বিচারক ইয়ারব হোসেন মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে ১৬ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর