ভোজনরসিক বাঙালির প্রিয় খাদ্যের মধ্যে অন্যতম রসনা দেশীয় প্রজাতির শুঁটকি। হরেক রকম রান্না করা যায় বলে দিন দিন বাড়ছে এর চাহিদা। স্বাদ-গন্ধে অতুলনীয় মিঠা পানির শুঁটকির প্রতি সবারই কমবেশি আগ্রহ আছে। নাটোরেও শুঁটকির কদর বাড়ছে দিন দিন। নানা জাতের শুঁটকি উৎপাদনে এ জেলার রয়েছে দেশজোড়া খ্যাতি।

চলনবিল-অধ্যুষিত নাটোরের সিংড়ার মিঠা পানির শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শুঁটকির উৎপাদনও। চড়া দামেই এসব শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের এক মাস বাকি থাকতেই গত বছরের তুলনায় এ বছর শুঁটকির উৎপাদন বেড়েছে ৯০ মেট্রিক টন। একটি মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে শুঁটকির উৎপাদন আরও বাড়বে বলে মনে করছেন উৎপাদনকারীরা।

শুঁটকির মধ্যে আছে পুঁটি, চিংড়ি, টেংরা, খলসে, বাতাসী, আইকোর, চাঁদা, চেলা, মলা, টাকি, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কইসহ বাহারি মাছ। বাঁশের মাচায়, ছইয়ে ঢাকা চালার নিচে স্তূপ করে রাখা শুকানো হয় শুঁটকি।

নাটোর জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সিংড়ায় চারটি চাতাল ও ৩০টি এলাকায় বিলের মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি তৈরি করেন ৩১৩ জন। ২০২০ সালে সিংড়ায় ৩১৯ মেট্রিক ট্রন শুঁটকি উৎপাদন হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪১২ মেট্রিক ট্রন।

দেশের চাহিদা মিটিয়ে এসব শুঁটকি বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশেও দিন দিন কদর বাড়ছে নাটোরের মিঠা পানির এসব শুঁটকির। তবে শুঁটকির চাহিদার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়তে থাকলেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ শুঁটকি উৎপাদনকারীদের। আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে ন্যায্যমূল্য থেকে তাদের বঞ্চিত করছেন বলে জানান শুঁটকি উৎপাদনে জড়িত ব্যক্তিরা।

শুঁটকিপল্লির বিস্তৃর্ণ এলাকা

নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের ধারে নিংগইন এলাকায় গড়ে উঠেছে চলনবিলের সর্বববৃহৎ শুঁটকি চাতাল। নারী-পুরুষ মিলে এই চাতালে কাজ করছেন ২৫ জন শ্রমিক। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ কাটা, বাছাই, ধোয়া, রোদে শুকানো, তোলার কাজে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করেন।

সরেজমিন নিংগইন শুঁটকি চাতালে গিয়ে দেখা যায়, নারী শ্রমিকরা বিলের তাজা টাকি মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ধোয়ার পর লবণ মেখে মাচায় মেলে দিচ্ছেন। সকালে রোদে দেওয়া ভেজা মাছগুলোও এপিঠ-ওপিঠ উল্টে রাখছেন। পুরুষ শ্রমিকরা চাতাল ঘরে রাখা শুঁটকিগুলো আবারও রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। রাস্তার পাশে মাচার ওপর শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ। মহাসড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে অনেকেই কিনে নিচ্ছেন শুঁটকি।

শুঁটকি উৎপাদকরা জানান, প্রতিবছর ভরা বর্ষায় প্রচুর মাছ বংশবিস্তার করে বিলের পানিতে। হাঁটুপানিতে নেমেই এসব মাছ ধরা যায়। তখন বাজারেও সস্তায় বিক্রি হয় মাছগুলো। চলনবিলের চাহিদা মিটিয়ে মাছগুলো বাইরে চলে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে কম দামে বিলের মাছগুলো কিনে বাইরের বাজারে চড় দামে বিক্রি করে। যেসব মাছ অবিক্রিত থাকে, সেগুলো কিনে নেন শুঁটকি উৎপাদকরা।

অক্টোবর থেকে পানি কমতে শুরু করায় শুকিয়ে যায় খাল ও বিলগুলো। তখন পলো বা হাত দিয়েই ধরা যায় টাকি, শোল, পাতাসি, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, গজার, মাগুর, কই চিংড়িসহ হরেক প্রজাতির দেশি মাছ। এসব মাছের কিছুটা বিক্রি হয় বিল-সংলগ্ন হাট-বাজারগুলোয় আর কিছুটা সরাসরি আসে শুঁটকি চাতালে।

দেশের বৃহৎ জলাভূমি চলনবিলে এখন থইথই পানি নেই― অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। তবে বিলের নিচু জায়গা বা বড় খালগুলোয় শুরু হয়েছে মাছ ধরার উৎসব। ভেসাল, সুতিজাল, বেড়জাল ও পলো দিয়ে মাছ ধরছেন জেলেরা। আর পাশেই বাঁশের ছাউনিতে বসানো হয়েছে শুঁটকির অস্থায়ী চাতাল। সেখানে মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের মাছের শুঁটকি উৎপাদন করা হচ্ছে।

খারাপ শুঁটকিগুলো বেছে আলাদা করে রাখা হচ্ছে

শেরকোল ইউনিয়নের পুঁটিমারী গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৬০) শুঁটকিপল্লিতে পুঁটি মাছ বিক্রি করতে এসেছেন। যদিও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। তবু যেন মনে হচ্ছিল সকালের সূর্যালোক স্বচ্ছ-সাদা পুঁটি মাছের ওপর ঠিকরে পড়ে চকচক করছে।

স্থানীয় মাছ বিক্রেতা নাছির উদ্দীন জানান, পানি শুকিয়ে বিলে এখন শুধু কাদা। তা ছাড়া আগের মতো মাছও নেই। কয়েক দিনে তার খলইয়ে কেজি দশেক পুঁটি উঠেছে। লবণ মেখে দুদিন পর প্রতি কেজি ১২০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তিনি।

নাছির উদ্দীনের থেকে কেনা পুঁটিমাছগুলো পানিতে ধোয়া শেষে লবণ মাখছিলেন শুঁটকিপল্লির চারটি চাতালের একটির মালিক হোসেন আলী। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও শুঁটকির মৌসুমে দিনে অন্তত ৫০ কেজি মাছ কিনতেন। এখন মাছ পাওয়া যায় মোটের ওপর ২৫ থেকে ৩০ কেজি। মাছের অভাবে আগের মতো শুঁটকি তৈরি করা হয় না।

অপর চাতালমালিক জহির হোসেন বলেন, এখন চলনবিলে মাছের সংকটের কারণে শুঁটকি তৈরিতে দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। মাছ বেশি বা কম হোক, শ্রমিকদের নির্ধারিত টাকাই মজুরি দিতে হয়। সব মিলিয়ে শুঁটকি তৈরিতে খুব একটা লাভ হয় না।

হঠাৎ চাতালমালিক আহমেদ কবীরের মাচায় এল টাকি মাছ। পানিভর্তি পাতিল থেকে বাঁশের ঝুড়িতে রাখার সঙ্গে সঙ্গে কমে এল টাকিগুলোর দাপাদাপি। তাজা মাছগুলো কাটতে বঁটি নিয়ে বসেছেন মাছকুটুনীরা। সফুরা, আমেনা ও রুপালীরা দক্ষ হাতে টাকির আঁশ ছাড়িয়ে কানকো কেটে পিত্ত বের করে রাখছেন আলাদা ঝুড়িতে। দিনপ্রতি ২০০ টাকা মজুরিতে তারা আধাবেলা মাছ কাটেন। কেউবা মাছ কাটার পর কিছু বাড়তি টাকার বিনিময়ে চাতালের মাচাগুলোতে মাছ রোদে শুকাতে দেন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় উল্টেপাল্টে বা শুঁটকি বাছাই করেন। শীত মৌসুমে শুঁটকিপল্লিতে কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তারা।

বিক্রেতারা জানান, শৈল মাছের শুঁটকির কেজি আকারভেদে ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা, পুঁটি ৩০০ টাকা, টাকি ৩৫০ টাকা, চেলা ৬০০ টাকা, পাতাসি ৮০০ টাকা, গুচি আকারভেদে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা, কাচকি ৭০০ টাকা, বোয়াল ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, চাপিলা ৪০০ টাকা, মলা ৫০০ টাকা ও বাইম ১০০০টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বছরের শুরুতে প্রতি কেজি ১৩০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এ বছর মাছের স্বল্পতার কারণে বিলের চিংড়ি মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি চিংড়ি মাছ খুবই সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে তোলামাত্র তা বিক্রি হয়ে যায়। শুঁটকি তৈরির জন্য চাতাল পর্যন্ত চিংড়ি আর আসে না।

তারা জানান, প্রক্রিয়াজাতকরণে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে। তাই খুচরা ক্রেতারও অভাব হয় না। চলনবিলের দেশীয় শুঁটকি যাচ্ছে ভারতেও। বৃহদাকারে শুঁটকির মূল ক্রেতা নীলফামারীর সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ শুঁটকি বিক্রি হয় এখান থেকে। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর, কক্সবাজার, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এখান থেকে শুঁটকি কিনে নিয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি করেন।

মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুঁটকি উৎপাদন পর্যন্ত জড়িত ব্যক্তিরা বলেন, চলনবিলে ফি বছর কমছে দেশীয় মাছ। তবে ভরা বর্ষায় কিছু মাছ বংশবিস্তার করে বিলের পানিতে। এক হাঁটুপানিতে নেমেই দ্রুতবর্ধনশীল এই মাছগুলো ধরা যায়। তখন বাজারেও সস্তায় বিক্রি হয় মাছগুলো। চলনবিলের চাহিদা মিটিয়ে মাছগুলো বাইরে চলে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে কম দামে বিলের মাছগুলো কিনে বাইরের বাজারে চড়াদামে বিক্রি করেন।

শুঁটকির উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এমন প্রেক্ষাপটে একটি মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে বর্ষার সময় মাছগুলো ধরে রেখে শীতের শুরুতে শুঁটকি তৈরি করা যেত। একটি মাছ সংরক্ষণাগারই উন্মোচন করতে পারে চলনবিলের মাছকেন্দ্রিক অর্থনীতির নতুন দিগন্ত।

উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লাহ ওয়ালীউল্লাহ বলেন, বিগত কয়েক বছর চলনবিলে পানি কম থাকায় মাছের জন্য অনুকূল পরিবেশ ছিল না। যে কারণে মাছ ও শুঁটকির পরিমাণ কমে গেছে । কিন্তু এবার বন্যার কারণে চলনবিলে মাছের উৎপাদন বিগত দিনের চেয়ে ভালো। গত বছর ২১০ টন শুঁটকি উৎপাদন করা হয়েছে। এবার উৎপাদন আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, শুঁটকিশ্রমিক ও মালিকদের আমরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। মৎস্য বিভাগ এ বিষয়ে সজাগ আছে।

এনএ/এসপি