পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। দিনে-রাতে ব্যবসাতেই ধ্যান। যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। ব্যস্তময় এ জীবনে শৌখিনতাও আছে তার। তিনি সুযোগ পেলেই ছুটে বেড়ান সবুজ-প্রতিকৃতিতে। শখ-সাধ্য আর পছন্দকে প্রাধান্য দিতে তিনি বেশ অনড়। এ কারণে বাড়ির ছাদবাগান নিয়ে উৎসাহিত হন তিনি। তাই নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন শখের সেই বাগান।

বৃক্ষপ্রেমী টেইলার্স ব্যবসায়ী বশীর আহম্মেদের শখের এই ছাদবাগানে রয়েছে নানা জাতের শাকসবজি, ফুল ও ফলের গাছ। রয়েছে ঔষধি গাছও। তার এ ছাদবাগান থেকে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টাকার ফল ও সবজি মিলছে। ৬ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত ভবনের ছাদে গাছগাছালির সমাহার ছাড়াও রয়েছে মুরগি ও কবুতর পালনের আলাদা শেড।

বশীর আহম্মেদ রংপুর মহানগরীর হনুমানতলা এলাকার বাসিন্দা। তার জন্মনিবাস ঢাকার অদূরে নবাবগঞ্জ থানার মহব্বতপুর গ্রামে। ব্যবসার কারণে নব্বইয়ের দশকে রংপুরে আসেন। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই নগরে তার বসবাস। বর্তমানে নগরীর হনুমানতলায় পরিবারসহ থাকতে তৈরি করেছেন পাঁচতলা এ বাড়ি।
 
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ছাদবাগানের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেন বশীর আহম্মেদ। তিনি জানিয়েছেন তার সফলতার কথা। জানিয়েছেন কীভাবে বাগান করেছেন, কোন কোন জাতের গাছ লাগিয়েছেন এবং পরিচর্যার কথা।

টেলিভিশনে কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের ছাদ কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখেই ছাদবাগান গড়ার শখ হয় বশীরের। এরপর বিভিন্নজনের ছাদবাগান দেখে অনুপ্রাণিত হন তিনি। তারপর ২০১২ সালে গড়ে তোলেন ছাদবাগান। ধৈর্য ধরে নিয়মিত পরিচর্যা করে এখন তিনি সফল ছাদবাগানি। শুরুতে পরিবার থেকে ছাদে বাগান গড়তে অনীহা থাকলেও পরে তার স্ত্রী ও সন্তান উৎসাহ জুগিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বশীর আহম্মেদের বাড়ির ছাদবাগানে রয়েছে কমলা, মাল্টা, ডালিম, হিমসাগর, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, হাঁড়িভাঙা, ফজলি আম, লেবু, পেয়ারা, আমড়া, ড্রাগন, ত্বিন, সফেদা, জাম্বুরা, কলা, জামরুল, কাঁঠালসহ অন্তত ৩০ প্রকার ফলের গাছ। সবজির মধ্যে করলা, বেগুন, টেমেটো, চিচিংগা, ঝিঙা, মরিচ, ক্যাপসিকাম, পুদিনাপাতা। রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের ফুল ও ঔষধি গাছ। বর্তমানে বাগানে ঝুলছে বিভিন্ন প্রকারের মৌসুমি ফল ও ফলেছে সবজি।

বশীর আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে জানান, তিনি ২০১০ সালে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এর দুই বছর পর ছাদবাগান গড়ার পরিকল্পনা করে সংগ্রহ করেন বিভিন্ন জাতের চারা। প্রথম দিকে ভবনের দ্বিতীয় ও পরে তৃতীয় তলায় ছাদবাগানের শুরুটা করেন। এরপর ধীরে ধীরে ভবনের ছাদ বাড়ার সঙ্গে তার শখের বাগান পৌঁছে যায় পঞ্চম তলায়। এই বাগান গড়তে ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে।

ছাদবাগান গড়ার আগ্রহ নিয়ে ব্যবসায়ী বশীর বলেন, ছাদবাগান গড়তে মন ও ধৈর্য থাকতে হবে। এটা আমার শখের বাগান। টাকাপয়সা নিয়ে কখনো ভাবিনি। বাড়ির ছাদের দুটি অংশ ফাঁকা ছিল। অবসরে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে থাকতে বাগান গড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। শাইখ সিরাজ ভাইয়ের ছাদ কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করে। বাগান করতে শুরুতে বৃক্ষমেলা ছাড়াও বগুড়া, দিনাজপুর ও রংপুরের মিঠাপুকুর, বুড়িরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাদ উপযোগী গাছের চারা সংগ্রহ করেছি।

তিনি আরও বলেন, অনেককে দেখেছি দশ শতক জমির মধ্যে পাঁচ শতকে বাড়ি তৈরি করে। আর বাকি পাঁচ শতকে গাছগাছালি লাগিয়ে পরিচর্যা করে। কিন্তু আমার ছয় শতক জমির তো কোথাও ফাঁকা জায়গা ছিল না। এ কারণে আমি ছাদের পুরো ছয় শতক জায়গায় ছাদবাগান গড়ে তুলি। বর্তমানে আমার বাগানে ৫০ থেকে ৬০টি গাছ রয়েছে। এই বাগান গড়তে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন বছরে এ বাগান থেকে ৩০-৪০ হাজার টাকার ফল, ফুল ও সবজি মিলছে।

প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর সকাল সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত বাগান পরিচর্যা করেন বশীর। কখনো এ কাজে তাকে স্ত্রী ও সন্তান সহযোগিতা করেন। তবে বেশির ভাগ সময় বাড়ির নিরাপত্তাপ্রহরী বাগান পরিচর্যা করেন। শুরুতে কয়েকজন দিনমজুর দিয়ে ছাদে ফল, ফুল ও সবজিগাছের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন। এরপর পরিচর্যায় মনোনিবেশ করেন বশীর আহম্মেদ।

শুরুতে একটু কষ্ট হয়েছে, এখন তার সুফল পাচ্ছেন জানিয়ে বশীর বলেন, এখন সেই ধৈর্যের ফল পাচ্ছি। ছাদবাগান থেকে রাসায়নিক ও বিষমুক্ত শাকসবজি ও ফল খাচ্ছি। এতে বাজারনির্ভরতা কিছুটা কমেছে আমার। পরিবারের যেমন পুষ্টির চাহিদা মিটছে, তেমনি আর্থিক সাশ্রয়ও হচ্ছে। বাগানে বারোমাসি আম ছাড়াও বারি জাতের বেশ কয়েকটি আমগাছ রয়েছে। গত বছর প্রচুর আম ধরেছিল।

বশীর আহম্মেদ জানান, ফরমালিনমুক্ত খাবার সবাই পছন্দ করে। এ কারণে বন্ধুবান্ধব মাঝেমধ্যে আমার ছাদবাগান দেখতে আসে। অনেকে পরামর্শও নেন। প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে ফল ও সবজি দিতে পারছি। এটা শখের বাগান, লাভ-লোকসানের হিসাব তেমন করি না। তবে বাগানে অবসর সময় কাটিয়ে এবং ভালো ফলন দেখে মনে প্রশান্তি খুঁজে পাই।

ভবিষ্যতে ছাদবাগান আরও সমৃদ্ধ করতে নতুন নতুন গাছ লাগানোর কথা জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, বাড়ির ছাদ ফাঁকা না রেখে ছোট পরিসরে হলেও বাগান করা উচিত। এতে শুরুতে একটু কষ্ট হলেও পরে মনমানসিকতা বদলে যাবে। বিশেষ করে যখন গাছে গাছে ফুল, ফল, সবজি দেখবে, তখন অন্য রকম অনুভূতি কাজ করবে। তা ছাড়া ফরমালিনমুক্ত নিরাপদ ফল এবং সবজির জন্য ছাদবাগান এখন বেশি গুরুত্ব বহন করছে।

ছাদবাগান করতে যা প্রয়োজন
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ছাদবাগান করতে ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, প্লাস্টিক ট্রে ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। বেলে-দোঁআশ মাটি বা লাল মাটি, পচা-শুকনা গোবর ও কম্পোস্ট, বালু ও ইটের খোয়া ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। ছাদবাগানে ছোট আকারের গাছে বেশি ফল ধরে। বেঁটে প্রজাতির বর্ধনশীল ফল প্রদানকারী গাছই ছাদবাগানের জন্য উত্তম। কলমের চারা লাগালে দ্রুত ফল পাওয়া যায়।

ছাদবাগানে দরকার যে ধরনের গাছ
ছাদবাগানে যেসব গাছ ভালো জন্মে বারি আম-৩ (আম্রপালি), বারি আম-৪, মলি¬কা, বাউ আম-২ (সিন্দুরী), পেঁপে, আতা, শরিফা, আঙুর, বাতাবিলেবু, কুল, সফেদা, ছোট জাতের কলা, ছোট জাতের আনারস, কামরাঙ্গা, জলপাই, পেয়ারা, করমচা ডালিম, কমলা, মাল্টা, জামরুল ইত্যাদি। শাকসবজি মধ্যে লালশাক, পালংশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, পুঁইশাক, লেটুস, বেগুন, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, চুকুর, ক্যাপসিকাম, শিম, বরবটি, শসা, করলা ইত্যাদি।

মসলাজাতীয় ফলনে রয়েছে মরিচ, ধনেপাতা, বিলাতি ধনিয়া, পুদিনা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, গোলমরিচ, পাম ইত্যাদি। ঔষধি গাছের মধ্যে অ্যালোভেরা, তুলসী, থানকুনি, চিরতা, স্টিভিয়া, গাইনোরা ইত্যাদি। ফুলজাতীয় গাছের মধ্যে গোলাপ, বেলি, টগর, জুঁই, গন্ধরাজ, জবা, টিকোমা, জারবেরা, শিউলি, এলামন্ডা, বাগান বিলাস ইত্যাদি ফুল ভালো জন্মে।

রংপুরে বাড়ছে ছাদবাগানের হালচাল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রংপুরে ছোট-বড় মিলে চার শতাধিক ছাদবাগান রয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শৌখিন বাগানীরা উদ্যোগী হয়ে উঠছেন। ফলে বাড়ির ছাদে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ ও নানা জাতের সবজি ও ফুলের শোভা বাড়ছে। এতে বিপন্ন প্রকৃতির মাঝে সবুজের বিপ্লব ঘটছে। সঙ্গে ছাদবাগান ঘিরে বাড়ছে বিশুদ্ধ অক্সিজেন-প্রবাহ।

ছাদবাগান গড়তে বিভিন্নভাবে পরামর্শ প্রদান ছাড়াও উৎসাহ দিয়ে আসছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। অনেকেই সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি সহযোগিতায় নিজের বাড়ির ছাদে গড়ে তুলেছেন ফল ও সবজির বাগান। অবসরে সেসব বাগান পরিচর্যা করে প্রশান্তি খুঁজছেন বাগানীরা।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, ছাদবাগান ব্যয়বহুল হলেও শৌখিন বাগানীরা গড়ে তুলছেন। কেননা, ছাদবাগান থেকে কীটনাশক ও বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। তা ছাড়া গাছের প্রতি ভালোবাসা থেকে বাড়ির ছাদে ফল, সবজি ও ফুলের বাগান করে পরিবারের পুষ্টিচাহিদা মেটাচ্ছেন অনেকে।

তিনি আরও বলেন, ছাদবাগান থেকে প্রায় বারো মাসই ফল ও সবজির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। সেদিকে লক্ষ রেখেই আমরা ছাদবাগানের পরামর্শ দিয়ে থাকি। ভবিষ্যতে ছাদবাগানের মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তা পূরণ হবে।

এনএ