‘কৃষকের পাকা ধানে মই’। ভারী বৃষ্টিপাতে এমন অবস্থাই হয়েছে দিনাজপুরে। কোথাও পাকা ধান নুয়ে পড়েছে, কোথাও আধা পাকা ধান কেটে নিচ্ছেন কৃষকরা। এমন অবস্থায় দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। আবার শ্রমিক পাওয়া গেলেও অর্ধেক ধান দিতে হচ্ছে তাদের। শেষ মুহূর্তে এসে কৃষকরা এখন দিশেহারা।

সরেজমিনে সদর, পার্বতীপুর ও চিরিরবন্দর উপজেলায় দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে টানা ভারী বৃষ্টি আর বাতাসে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা পাকা ধান মাটিতে পড়ে ও পানিতে তলিয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও ধান কেটে বেঁধে জমিতে রাখার পর এখন বৃষ্টির পানিতে ভাসছে। অনেকে আবার আধা পাকা ধান এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কেটে ফেলছেন। এতে ফলন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বলে জানান কৃষকরা।

কৃষকরা জানান, গত মৌসুমে ইরি-বোরো বিঘাপ্রতি ৪০ থেকে ৪৫ মণ করে হলেও এবার বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ মণ ফলন হয়েছে। এদিকে শ্রমিক সংকটে দিশেহারা কৃষক জমির অর্ধেক ধান শ্রমিকদের মজুরি দিতেই চলে যাচ্ছে। তবু সময়মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তারা।

সদর উপজেলার মোহনপুর এলাকার কৃষক ইয়াসিন আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আট বিঘা জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছি। পাঁচ বিঘা কাটছি হারভেস্টার মেশিন দিয়ে। বাকি জমির ধান কাটতে পারি নাই ঝড়-বৃষ্টিতে ধান মাটিতে পড়ে গেছে। এখন তো শ্রমিক পাওয়াই যাচ্ছে না। বাইরের উপজেলা থেকে ধান কাটা শ্রমিক এনেছি। ১০ হাজার টাকা বিঘা দাম দিয়ে পড়া ধান কাটতে লাগিয়ে দিয়েছি। তবু ধান কাটতে চান না শ্রমিকরা। জমির অর্ধেক ধান শ্রমিকদের মজুরি দিতেই চলে যাচ্ছে। এবার খুব লসের মুখে পড়েছি।

একই গ্রামের কৃষক ফজর আলী বলেন, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে তড়িঘড়ি করে কিছু জমির ধান কেটে ঘরে তুলেছি। গত দুই রাতের বৃষ্টি আর বাতাসে আমার চার বিঘা জমির পাকা ধান মাটিতে পড়ে গেছে। এখন দ্বিগুণ দাম দিয়ে এ ধান কাটাতে হবে। তাও মিলছে না শ্রমিক। কারণ মাটিতে পড়া ধান কাটতে চান না শ্রমিকরা। আবার পাওয়া গেলেও বিঘাপ্রতি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা চাচ্ছে। উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে বেশি দামে কাটাচ্ছি। এমনিতে বাজারে ধানের দাম কম। কষ্ট করে ধান ফলিয়ে যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে।

চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক মনির ইসলাম বলেন, আমার পাঁচ বিঘা জমির পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন ধান কাটব কী করে? শ্রমিক না পেয়ে হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটার কথা আজ। কিন্তু ধান মাটিতে পড়ে যাওয়ায় হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কাটা সম্ভব নয়। জমির পানি শুকালে তখন কাটাতে হবে শ্রমিক দিয়ে। পড়ে যাওয়া ধান কাটতে খরচ বেড়ে যাবে আবার সময়মতো ধান কাটাতে না পারলে জমিতে ধান পচে যেতে পারে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৭৪ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে ৭ লাখ ২৯ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৭১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ৭ লাখ ৩১ হাজার ১৭৩ মেট্রিক টন এবং ২০২০-২১ মৌসুমে ১ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে ৭ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃষ্টিতে ধানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তেমন একটা নেই। কিছু জায়গায় ধানের জমিতে পানি আটকে গেলেও আমরা কৃষকদের পানি বের করার জন্য বলেছি। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। পানি লেগে থাকা ধান কৃষকরা কেটে নিচ্ছেন। আশা করছি তেমন ক্ষতি হবে না।

জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দখিনা বাতাসের সঙ্গে পশ্চিমা লঘু চাপের সংমিশ্রণের কারণে আকাশে প্রচুর মেঘমালার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি হিমালয় পর্বমালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য আকাশ সব সময় মেঘলা থাকছে।

আগামী পাঁচ-সাত দিন এ ধরনের আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, কালবৈশাখীর সম্ভাবনা নেই। তবে বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস বইতে পারে।

ইমরান আলী সোহাগ/এনএ