পটুয়াখালী সদর উপজেলার ফিরোজ বিশ্বাস একজন খামারি। বংশপরম্পরায় তিনি এ পেশায় জড়িত হন। তার বাবা-দাদাও খামারি ছিলেন। ভেবেছিলেন খামার করেই পরিবারে সচ্ছলতা আনবেন। কিন্তু গোখাদ্যের আকাশচুম্বী দামে তিনি এখন দিশেহারা। কোনো কোনো খাদ্যের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ফিরোজ বিশ্বাস এখন ভাবছেন- এ পেশায় অনেক হয়েছে, এবার বড় ক্ষতির আগেই ইতি টানতে হবে।

তার মতে, গবাদি পশুর দানাদার খাদ্যসামগ্রীর দাম এখন নাগালের বাইরে চলে গেছে। দিন দিন গোখাদ্যের দাম বেড়ে এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। এতে গবাদি পশুকে দানাদার খাবার কিনে খাওয়ানোর উপায় নেই খামারিদের। কিন্তু বিপরীতে দুধের দাম বাড়েনি। এ নিয়ে সরকারসহ কারও কোনো মাথাব্যথা নেই বলেই তাদের ক্ষোভ-দুঃখটা আরও বেশি।

গমের ভুসি, সয়ামিল, ভুট্টা, মুগের ভুসিসহ অন্যান্য ভুসির অস্বাভাবিক দামের জন্য আমদানিকারক ও মিলারদের কারসাজি এবং এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মনিটরিং না থাকাকে দায়ী করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

খামারি ফিরোজ বিশ্বাস বলেন, তিন মাস আগে যে দামে গরুর খাবার কিনেছিলাম, এখন সেই দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। এ ছাড়া খামারে যেসব শ্রমিক কাজ করে, তাদের বেতন বাড়াতে হয়েছে। অথচ গরুর দুধের দাম বাড়েনি। আমার বাবা এই পেশায় জড়িত ছিলেন, এখন আমি করছি। কিন্তু অতীতে কখনোই এত দাম বাড়েনি গোখাদ্যের। জানি না আর কতদিন খামার পরিচালনা করতে পারব।

শুধু ফিরোজ নন, স্থানীয় অনেক খামারিই এখন আছেন অনিশ্চয়তায়। এ খাতে আর বিনিয়োগ করবেন কি না তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন তারা। সবাই অপেক্ষায় আছেন সরকার তাদের দিকে সুনজর দেবে সেই আশায়।

খামারিরা জানান, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলে উন্নত জাতের ঘাষ চাষ করা হয় না। এ কারণে এ এলাকার খামারিরা খড় ও দানাদার খাবার খাইয়ে গবাদি পশু পালন করে থাকেন। তবে দানাদার খাবারের বাজার এমন নিয়ন্ত্রণহীন থাকায় অনেকেই খামার বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই গরু বিক্রি করে খামারের পরিধি ছোট করছেন। অনেকে খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন।

খামারের দায়িত্বে নিয়োজিত শ্রমিক রফিক হোসেন বলেন, দিন দিন সবকিছুর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরুর খাবারের দামও বেড়েছে। এখন আর গরু পালার কোনো সুযোগ নেই। ছয় মাস আগে যে গমের ভুষি কিনেছি ৮০০ টাকায়, এখন তা ১৭০০ টাকা। আগে যে ভুট্টার গুঁড়া কিনেছি ১২০০ টাকায়, এখন তা ১৯০০ টাকা। ৪০ কেজির মুগের ভুষি আগে ১৩০০ টাকায় কিনলেও এখন সাড়ে ১৮০০ টাকা। আর সয়ামিলের দাম এত বেশি বেড়েছে যে এখন আর তা গরুকে খাওয়াচ্ছি না।

তিনি আরও বলেন, খাবারের দাম বাড়লেও সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে দুধের দাম উল্টো কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন খামার অনেক লসে আছে। মালিকপক্ষের টিকে থাকাটাই এখন দুষ্কর। সরকারকে আমাদের দিকে তাকাতে হবে। না হয় আমাদের কর্ম বন্ধ হয়ে বেকার হয়ে যাব।

পটুয়াখালী শহরের পুরান বাজার এলাকার ভুসিমাল বিক্রেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের অজুহাতে যেই গমের দাম বাড়ল, সেই থেকে গমের ভুসির দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। এ ছাড়া যখনই সয়াবিন তেলের দাম বাড়ল, সে সময় থেকে সয়ামিলের ভুসির দামও বাড়ানো হয়েছে। আর আমাদের এই অঞ্চলে খুব বেশি ভুট্টার আবাদ হয় না। এ কারণে যেসব এলাকায় ভুট্টা উৎপাদিত হয়, সেসব এলাকা থেকে সরাসরি বিভিন্ন ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভুট্টা কিনে নিচ্ছে। এতে ভুট্টার বাজারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।

পটুয়াখালী জেলা ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। গোখাদ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। কোথাও কোনো তদারকি কিংবা মনিটরিং নেই। দাম কমারও কোনো লক্ষণ নেই। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে শত শত খামারিকে পথে বসতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। আমাদের এই পেশার সঙ্গে হাজার হাজার শ্রমিকের পরিবার জড়িত। একবার বন্ধ হয়ে গেলে সেই ক্ষতি আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

পটুয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, সারা বিশ্বেই খাবারের দাম বেড়েছে। তবে কীভাবে খামারিদের টিকিয়ে রাখা যায়, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এ জন্য খামারিদের উন্নত জাতের ঘাষ চাষে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সরকার একটি প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের ঘাষ চাষে সহযোগিতাও দেবে। পাশাপাশি যেসব খামারি আগামী কোরবানি উপলক্ষে গরু মোটাতাজা করছেন, তাদের জন্য ইউরিয়া মোলাসেস তৈরি করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে গবাদি পশুর খাবারের পাশপাশি মুরগি ও মাছের খাবারেরও দাম বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে এখনই উদ্যোগ না নিলে মাছ ও মাংসের বাজারেও মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এনএ