নিষেধের বেড়াজালে ৫ বছর বন্দী জালের মানুষগুলো
টেকনাফের কালা মিয়া ( ৬৫) শৈশব থেকে নাফ নদীতে মাছ ধরছেন। নাফ নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তিনি। সারা জীবনে মাছ শিকার করা ছাড়া আর কিছুই জানেন না নাফ নদীর এই জেলে। এ পেশাকে পুঁজি করে তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কালা মিয়ার বাড়ি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া নাফ নদীর পাড়ে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ত্রিপল মোড়ানো তার বাড়িটি। বৃষ্টি ও জোয়ারে পানি ঢোকে বাড়িতে। আয় বন্ধ, তাই এখন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার।
বিজ্ঞাপন
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে জেলে পরিবারে দুর্দিন চললেও নাফ নদীতে মাছ ধরার অনুমতি মিলছে না। তখন থেকে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অর্ধশতাধিক নৌকা ঘাটে নোঙর করে আছে। কিছু নৌকা অকেজো হয়ে পড়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে তীরে।
কালা মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে এমনিতেই নাফ নদীতে নানা সময়েই মাছ ধরার ওপর বিজিবির বিধিনিষেধ থাকে। তাও মোটামুটি জীবন চলত। কিন্তু এখন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে তাদের জীবন আর চলছে না।
বিজ্ঞাপন
ইয়াবা ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অজুহাতে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে। একটানা মাছ শিকার বন্ধ থাকায় অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন কাটাচ্ছে নদীনির্ভর কয়েক হাজার জেলে পরিবার। পাঁচ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ শিকারের ওপর প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার ফলে জেলেদের সন্তানদের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেছে।
বিকল্প কোনো আয়ের উৎস না থাকায় জেলে পরিবারের মধ্যে চলছে হাহাকার। অনেকেই দুবেলা খাদ্য জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানা গেছে। অথচ ইয়াবা চোরাচালান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি।
এদিকে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় নাফ নদীর পাশ্ববর্তী বাজারগুলোতেও মাছের সংকট চলছে। এ ছাড়া টেকনাফে মিঠাপানির মাছ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ফলে নাফ নদী ও সাগরের মাছের ওপর পুরো উপজেলা নির্ভরশীল।
টেকনাফের নাফ নদীর জেলে পাড়াগুলো হচ্ছে টেকনাফ পৌরসভার জালিয়া পাড়া, কায়ুকখালী পাড়া, সদরের নাজির পাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়া, সাবরাংয়ের নয়া পাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের হোয়াব্রাং, নাটমুড়া পাড়াস্থ জেলে পাড়া, হোয়াইক্যংয়ের খারাইংগ্যাঘোনাসহ আরও কয়েকটি জেলেপলি রয়েছে।
এখানের ১০ হাজার জেলে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে তারা এ পেশা ছাড়তে পারবেন না বলে জানিয়ে বলেন, আমরা প্রয়োজনে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেব।
নৌকামালিকের স্ত্রী জুহুরা খাতুন (৪০) বলেন, রোহিঙ্গা ও ইয়াবার কারণে আমাদের মৌলিক অধিকার হরণ ও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এটা তো হতে পারে না! আমরা এর সুষ্ঠু প্রতিকার চাই।
টেকনাফ পৌরসভার জালিয়া পাড়ার দুজন জেলে বলেন, ১০ কেজি চাল নিয়ে কদিন চলব? আমরা নাফ নদীতে মাছ শিকার করে বাঁচতে চাই। নিষেধাজ্ঞার আগে বছরের পর বছর ধরে নাফ নদীতে বিহিঙ্গি জাল পেতে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। কোনো কালেই এভাবে দীর্ঘদিন মাছ শিকার বন্ধ থাকেনি। এখন হাজার হাজার জেলে পরিবারে চলছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা।
টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, সরকারের নির্দেশ আগের মতো বলবৎ থাকায় এখন পর্যন্ত নাফ নদীতে মাছ শিকারের কোনো সুযোগ নেই। অনুমতি না পাওয়ার আগ পর্যন্ত নদীতে মাছ ধরার সুযোগ নেই। মাদক ও মানব পাচার প্রতিরোধে বিজিবি সর্বদা জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কায়সার খসরু বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। কখন থেকে নাফ নদীতে জাল না ফেলার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা আমার জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চিঠি পাঠানো হবে। পাশাপাশি সেসব জেলেকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে থেকে সহযোগিতা করা হবে।
সাইদুল ফরহাদ/এনএ