দিনের আলোয় চলাচল সহজ হলেও সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। হেডলাইট না জ্বালিয়ে তখন যান চলাচল বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো অন্ধকারে ঘটছে দুর্ঘটনাও। প্রশাসনের টহল না থাকায় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে বাড়ছে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। সঙ্গে ল্যাম্প পোস্টের অচল বাতির নিচে কেউ কেউ মাদক সেবন করছে। আবার কেউবা জড়িয়ে পড়ছে অসামাজিক কার্যকলাপে।

এ চিত্র রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে নির্মিত শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর। দীর্ঘ সাড়ে তিন মাস ধরে অন্ধকারে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে তিস্তা নদীর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সেতুটি। দিনের আলো ফুরিয়ে রাতে সেতুর বাতির নিচের অন্ধকারে সাধারণ দর্শনার্থী ও ভ্রমণপিপাসু মানুষরা এখন অনেকটাই অনিরাপদ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সেতুর ল্যাম্প পোস্টের বাতিগুলো নষ্ট হয়ে আছে। এতে রাতে সেতু দিয়ে চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে অন্ধকারে সেখানে মাদক সেবন, মাদক পরিবহনসহ নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপ বাড়ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, থানা-পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল অধিদপ্তরকে বিষয়টি জানিয়েছেন তারা। কিন্তু সাড়ে তিন মাস ধরে অন্ধকারে রয়েছে সেতুটি। এখনো সেতুর ল্যাম্প পোস্টের নষ্ট বাতিগুলো মেরামত বা নতুন বাতি লাগানোর কোনো উদ্যোগ তাদের চোখে পড়েনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর ল্যাম্প পোস্টের বাতিগুলোর বেশির ভাগই অচল। সন্ধ্যার পর আলো জ্বলছে না।  অন্ধকারে চলাচলরত বেশির ভাগ গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে। প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাস, পিকআপ, থ্রি-হুইলার, রিকশা, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল ছাড়া এ সেতু দিয়ে অন্য ভারী কোনো যানবাহন চলাচল করে না। এ কারণে হালকা যানবাহনগুলো প্রায়ই বেপরোয়া গতিতে সেতুর ওপর দিয়ে ছুটতে দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকার লিমা মাহবুব জানান, সেতুর বাতিগুলো প্রায়ই নষ্ট হয়। ঠিক মতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বাতিগুলো বন্ধ হয়ে আছে। এগুলো দেখভালের জন্য কেউ আসেও না। আগে আমরা পরিবারের সদস্যরা সন্ধ্যা হলে হাঁটতে হাঁটতে সেতুতে যেতাম। কিন্তু এখন সন্ধ্যার পরই সেতুর ওপর অন্ধকার হয়ে যায়। এই অবস্থায় বখাটে ছেলেদের উৎপাতে সেতুতে চলাফেরা করাটা অনিরাপদ।

সেতুর একপ্রান্তে ফাস্ট ফুডের দোকান রয়েছে আসিফ হোসেনের। সেতু দেখতে আসা দর্শনার্থীদের ঘিরেই তার ব্যবসা। কিন্তু দীর্ঘদিন সেতু অন্ধকারে থাকায় তার ব্যবসা ভালো হচ্ছে না বলে জানান তিনি। তরুণ এই ব্যবসায়ী বলেন, শুধু অন্ধকারের কারণে কিছু দিন আগে সেতুর ওপর একটি মালবাহী ট্রলি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। মোটরসাইকেল চালকেরাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। সেতুর বাতিগুলো সচল থাকলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না। দ্রুত ল্যাম্প পোস্টের বাতিগুলো মেরামত করা দরকার।

রংপুর নগরীর বাবুখা এলাকা থেকে মহিপুরে ঘুরতে আসা আহসান হাবিব মিলন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি মাসে একবার হলেও শুধু তিস্তা নদী দেখার জন্য এখানে ঘুরতে আসি। নদীর আশপাশের নিরিবিলি পরিবেশ আর সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট খুবই ভালো লাগে। কিন্তু দুই তিন মাস ধরে সেতুর বাতিগুলো নষ্ট খেয়াল করছি। সন্ধ্যার পর বাল্বগুলো ঠিকমতো জ্বলছে না। এতে দূর থেকে পুরো সেতু অন্ধকার লাগে। এ কারণে মন চাইলেও সন্ধ্যার পর এখানে ঘুরতে এসে বেশিক্ষণ থাকাটা সম্ভব নয়।

স্থানীয় সংবাদকর্মী আব্দুর রহিম পায়েলের সঙ্গে কথা হয় সেতুর ওপর। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আমরা তো লেখালেখি করছি। বিষয়টি সবাই জানে। কিন্তু নষ্ট বাতিগুলো মেরামতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সেতুটি অন্ধকারে থাকায় অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটছে। তাছাড়া শেখ হাসিনা সেতু অন্ধকারে থাকায় এলাকার ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

এই সেতু দিয়ে নিয়মিত রংপুর যাতায়াত করেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা উত্তরবাংলা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ সরকার। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতুটি দুই জেলার মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  প্রতিদিন হাজারো মানুষ এবং যানবাহন চলাচল করছে। দিনের বেলা কোনো সমস্যা না হলেও রাতে অন্ধকারের কারণে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাতিগুলো নষ্ট থাকায় রাতে অন্ধকার সেতুর ওপরে বখাটের আড্ডা এবং মাদক সেবন বাড়ছে। দ্রুত বাতিগুলো সংস্কার  করাসহ এই সেতুর ওপর পুলিশি টহল জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি।

রংপুর সিটি করপোরেশনে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার আল-আমিন সুমন ঢাকা পোস্টকে জানান, গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর ৩২টি ল্যাম্পপোস্ট অকেজো। জ্বলছে মাত্র ৬-৭টি। গত বছর সিটি মেয়রের সহযোগিতায় কিছু নষ্ট বাতি সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু আবার সেই আগের চিত্র। সেতুর বেশির ভাগ বাতি নষ্ট হয়ে আছে। সন্ধ্যা নামলে সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করতে ভয় কাজ করছে।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য (মেম্বার) মুন্নাফ হোসেন জানান, ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এখন বাতি বন্ধ থাকায় রাতে জনসাধারণের চলাচলে দুর্ভোগ বেড়েছে। এই সেতু দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে করে প্রতিদিন অন্তত দুই জেলার ৩০-৩৫ হাজার মানুষ চলাচল করে। বিকেলে বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজারো মানুষ নদীর তীরে ঘুরতে আসে। বাতিগুলো বন্ধ থাকায় সন্ধ্যার পর তাদের ভোগান্তির পোহাতে হয়।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতুর বাতিগুলো নষ্ট থাকার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজ চোখে পড়েনি। অথচ সেতুর বাতিগুলো বন্ধ থাকায় সন্ধ্যার পর প্রায়ই মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বহিরাগত বখাটে ছেলেরা রাতে সেতুর ওপরে মাদক সেবন করছে বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগও পেয়েছি। বাতিগুলো যেন মেরামত করা হয়, এজন্য প্রয়োজনে আবারো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানাব। তা না হলে সেতুর ওপর অন্ধকারে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।

এ প্রসঙ্গে গঙ্গাচড়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল হোসেন বলেন, ওই এলাকায় দায়িত্বে থাকা বিট অফিসারকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য বলা হয়েছে। এখন পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বিষয়টি উপস্থাপনের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগকে দ্রুত বাতিগুলো সংস্কারের জন্য অনুরোধও করেছি। তবে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করাসহ মাদক সেবনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে।  

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদ উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সেতু কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। এসব মেরামতে ঢাকায় কাজগপত্র পাঠানো হয়েছে। আশা করছি ১৫-২০ দিনের মধ্যে সেতুর বাতিগুলো মেরামত করা সম্ভব হবে।

একই কথা জানান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকৌশলী মজিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সেতুর নষ্ট বাতিগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর