সতী নদীর ওপরের সেতু ভেঙে যাওয়ায় প্রায় ৭৬ লাখ টাকা বরাদ্দ হয় সেতু নির্মাণের জন্য। কিন্তু সময় শেষ হলেও সেটি নির্মিত হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীসহ চার গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ পড়ে দুর্ভোগে। তাই ১৭ ফুট একটি ড্রাম ও বাঁশ দিয়ে সাঁকো নির্মাণ করে যোগাযোগের নতুন দ্বার খুলে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম আলী।

জানা যায়, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের শালমারা ঘাটে গেল বর্ষায় সেতুটি ভেঙে যায়। এতে চার গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়ে। কোমরসমান পানি পার হতে গিয়ে নারী-শিশু ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। রোগীরা পড়ে আরও বিপদে।

পরে চলমান অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৭৫ লাখ টাকার ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করার দরপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু পানি থাকায় সেতু নির্মাণের কাজ দেরিতে শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহরিয়ার এন্টারপ্রাইজ।

গ্রামবাসীর দুর্ভোগ কমাতে সেখানে গণস্বাক্ষর নেওয়ার পরিকল্পনা করেন শালমাড়া ঘোনাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম আলী। টানা এক মাস গ্রামবাসীর সঙ্গে তিনি কথা বলেন। সবার সাড়া পেলেও অর্থের কাছে থেমে যায় বিশাল উদ্যোগ। পরে ছয় বন্ধু মিলে শুরু করেন সাঁকো নির্মাণ।

সেই কাজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন গ্রামের তরুণ-যুবকরা। এতে প্রধান শিক্ষকের সহকর্মী, গ্রামবাসী, ঠিকাদারসহ অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পানির ওপর ভাসছে ১৭ ফুট দীর্ঘ সাঁকোটি। প্লাস্টিকের ড্রাম শিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। সাঁকোটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ ভিড় করছে। ১৭ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকোটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিমের এমন উদ্যোগ খুশি পুরো গ্রামবাসী। এখন নির্বিঘ্নে যাতায়াত করছে শিক্ষার্থীসহ ১৫ হাজার মানুষ।

ক্ষুদে শিক্ষার্থী সাফিয়া আলম শিমু বলে, স্কুলে গেলে জামা-কাপড় সব ভিজে যেত। সাঁকোটি নির্মাণ হওয়ার কারণে এখন সুন্দরভাবে স্কুলে যেতে পারছি। স্যারের উদ্যোগে সাঁকোটি নির্মিত হয়েছে। স্যারকে অনেক ধন্যবাদ। তবে নতুন সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করার অনুরোধ করে শিমু।

স্থানীয় নওদাবাস দাখিল মাদরাসার সুপার রুহুল আমিন বলেন, শালমারা ঘাটে চলাচল করার জন্য একটি সেতু ছিল। বর্ষায় সেটি ভেঙে যায়। তখন থেকে চার গ্রামের মানুষের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন হলে প্রায় তিন কিলোমিটার দিয়ে হাটবাজার করতে হতো। প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম আমাদের কষ্ট লাঘব করা উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সাঁকো নির্মাণ করার কথা ছিল চেয়ারম্যান-মেম্বারদের। তারা না পারলেও শিক্ষক সেটি করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রশিদ বলেন, এক বুক পানিতে অনেক সময় বাড়ি ফিরতাম। সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর দুর্দশায় ভুগেছি। এখানে দেখার কেউ নেই। চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ দেখে না। আমরা খুব কষ্ট করে নদী পার হতাম। এখন সাঁকো দিয়ে খুব সহজেই কলেজে যেতে পারব। এখন সাঁকোটি হওয়ায় আমরা খুব খুশি। তবে সতেুটি যেন দ্রুত নির্মাণ করা হয়।

শালমাড়া ঘোনাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম আলী বলেন, বন্যার সময় সতী নদীর ওপর নির্মিত সেতু ভেঙে গেলে তখন থেকেই গ্রামের মানুষসহ শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ শুরু হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পানিতে কাপড় ভিজে স্কুলে যাওয়া লাগত। নদীর দুপাশের প্রায় ১৫ হাজার মানুষের এমন কষ্ট দেখে কয়েকজন মিলে উদ্যোগ নিয়ে সাঁকোটি তৈরি করেছি। ১৭ ফুট দৈর্ঘ্যের সাঁকোটি তৈরিতে ২০টি ড্রাম ও শতাধিক বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। ভাসমান ড্রামের ওপর বাঁশের মাচা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে লক্ষাধিক টাকা।

কালীগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম বলেন, প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম আলী যে কাজ করেছেন, সেটি সত্যি প্রশংসনীয়। ভেঙে যাওয়া সেতুটি সংস্কারে টেন্ডার হয়েছে। কাজ চলমান রয়েছে। হঠাৎ বৃষ্টি ও পানি বেড়ে যাওয়ায় কাজ শুরু করতে পারছে না ঠিকাদার। পানি কমে গেলে সেতুর কাজ আবার শুরু হবে।

নিয়াজ আহমেদ সিপন/এনএ