সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নি বিস্ফোরণের একদিন পেরিয়ে গেছে। এখনও ছেলের খোঁজ পাননি ভ্যানচালক বাবা সাইফুল ইসলাম। সন্তানের কথা মনে পড়তেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা ফুলমতি বেগম। চিকিৎসকের পরামর্শে তাদের দুজনের শরীরে স্যালাইন লাগানো হয়েছে।

কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে গিয়ে নিখোঁজ ফায়ার ফাইটার ফরিদুজ্জামান ফরিদ। একমাত্র ছেলে সন্তানের অপেক্ষায় বাড়িতে প্রহর গুনছেন হতদরিদ্র মা-বাবা। আত্মীয়-স্বজনসহ প্রতিবেশী সবার চোখ টেলিভিশনের পর্দায় আর নিউজ পোর্টালগুলোতে। কখন মিলবে নিখোঁজ ফরিদের সন্ধান।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আদারহার দক্ষিণ সরকারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ফরিদুজ্জামান ফরিদ। এক মাস আগে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে যোগ দেন। সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের প্রথম ইউনিটে ছিলেন ফরিদ। সহকর্মীদের সঙ্গে কনটেইনার ডিপোতে ফরিদ শুরুতেই প্রবেশ করেছিলেন বলে জানান পরিবারের লোকজন। এরপর থেকে তার আর খোঁজ মিলছে না। বেঁচে ফেরা সহকর্মীদের কাছেও নেই কোনো তথ্য।

সাইফুল ও ফুলমতি দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ফরিদুজ্জামান ফরিদ বড়। তার ছোট বোন সাবিহা আকতার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। নিখোঁজ ফরিদের সন্ধানে ইতোমধ্যে সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা করেছেন নিকট আত্মীয়রা।

ফরিদের চাচা তোতা মিয়া জানান, ছোটবেলা থেকে ফরিদ মেধাবী ও শান্ত-নম্র ছিলেন। গ্রামের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। পরিবারে দুঃখ কষ্ট থাকলেও বাবা দিনমজুরি ও ভ্যান চালিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন। বছর দুয়েক আগে চাকরির প্রথম কর্মস্থল হিসেবে সীতাকুণ্ডে যোগদান করেন ফরিদ।

ছেলে চাকরি করলেও ভ্যান নিয়ে ছুটে চলা বন্ধ হয়নি বাবা সাইফুল ইসলামের। বরং ছেলে আর বাবা মিলে পরিবারকে একটু সাজিয়ে নিতে করেছিলেন পরিকল্পনা। ইচ্ছে ছিল ছেলে ফরিদ আর একটু স্বাবলম্বী হলেই ভ্যানের চাকা ঘুরাবেন না তিনি। পেশা পরিবর্তন করে ছেলের মন মতো গুছিয়ে নেবেন সংসার।

কিন্তু সে আশা-স্বপ্ন এখন ফিকে হতে বসেছে। অগ্নি বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও ফরিদের সন্ধান না পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সাইফুল ও ফুলমতি। একমাত্র ছেলেকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা-বাবা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বাড়ির উঠানের দিকে। কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই তাদের। ফরিদের ছবির দিকে তাকিয়ে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তারা।

১৭ নম্বর ইমাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম ডানো রাতে নিখোঁজ ফরিদুজ্জামানের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, ফরিদের মা-বাবার অবস্থা ভালো না। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরিবারের সবাই নিখোঁজ ফরিদের সন্ধান পেতে চেষ্টা করছে। তাদের আত্মীয়ের মধ্যে দুই-তিনজন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন।

রংপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী বলেন, বছর দুয়েক আগে সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ফায়ার ফাইটার (সিপাহি) পদে যোগ দেন ফরিদুজ্জামান ফরিদ। শনিবার (৪ জুন) রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর থেকে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ফরিদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিতে আমরাও উদ্বিগ্ন।

এদিকে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে লাগা আগুনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ জনে। এদের মধ্যে ৯ জন ফায়ার সার্ভিসকর্মী। তবে ফায়ার সার্ভিসের আরও অন্তত চার কর্মী নিখোঁজ আছেন। এরমধ্যে রংপুরের ফরিদুজ্জামান ফরিদ একজন। এ ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন দুই শতাধিক মানুষ। ফায়ার সার্ভিস বলছে, লাশের সারি আরও দীর্ঘ হতে পারে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএইচএস