‘বাড়ি থাকি টাউনোত যাবার এই একনায় রাস্তা। তারে মাঝোত এক বছর ধরি ব্রিজ ভাঙি পড়ি আছে। ভোটের আগোত সোগ প্রার্থী এই রাস্তা আর ব্রিজ ঠিক করি দেবার চাইছে। আর অ্যালা মেম্বার-চেয়ারম্যান কারও পাত্তা নাই। ওমরা অ্যালা হামার এই ভাঙা ব্রিজ খুঁজি পাওছে না বাহে। তোমরা একনা ছবি তুলি চেয়ারম্যান সাইবোক দেকান বাহে। কতাত কয় না, কার কতা কায় শোনে, চৌত মাসোত বান! হামারে হইছে সেই দশা।’

অনেকটা আক্ষেপ থেকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কৃষক মোকছেদ আলী। বয়স ষাটের কাছাকাছি। সার কিনতে শহরে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ এই প্রতিবেদককে ছবি তুলতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। এরপর কাছাকাছি গিয়ে গ্রামের একমাত্র যাতায়াতের ব্যস্ততম সড়কটিতে থাকা ভাঙা সেতুটির কথা বলেন তিনি।

মোকছেদ আলী বলেন, ওই যে দ্যাকো মোটরসাইকেল ধরি লোকটা কেমন কষ্ট করি পার হওছে। সারাদিন মাইনসে এই রাস্তা দিয়্যা চলাফেরা করে। বাহে সবাই এই ভাঙা সেতু চোখে দ্যাকে, খালি হামার মেম্বার-চেয়ারম্যানে দ্যাকেনা। ওই তকনে এবার ভোট আসুক ওমাকগুল্যাক বস্তা ভত্তি করি ভোট দেমো।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের উত্তর হাজীপুর (হাজীপাড়া) গ্রামের বাসিন্দা ওই কৃষক। তার মতো হাজারো মানুষ থাকেন ওই গ্রামে। কিন্তু হাজীপুর গ্রামের এই সড়ক পথে চলাচল করেন আশপাশের আরও ছয় গ্রামের মানুষ। ব্যস্ততম সড়কের ওপর নির্মিত সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় এখন পুরো সাত গ্রামের অন্তত দশ হাজার মানুষজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ইকরচালী ইউনিয়নের উত্তর হাজীপুর (হাজীপাড়া) গ্রামের সড়কটি ধরে প্রতিদিনি বারাইপাড়া, জনেরপাড়া, তালেবারটারী, চৌকিদারপাড়া, পানো কাপরিয়ারটারী, ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের হাজারো মানুষ যাতায়াত করছেন। তারাগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে এবং রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের বামনদীঘি এলাকার নিকটবর্তী হওয়ায় একমাত্র যাতায়াতের সংযোগ সড়ক এটি।

শুধুমাত্র সংযোগ সড়কে যাবার পথে থাকা ভেঙে পড়া সেতুটির কারণে ব্যস্ততম এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা পথচারী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষজনকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শষ্য নিয়ে ৫ কিলোমিটার পথ ঘুরে গুণছেন বাড়তি ভাড়া। সেতুটি ভেঙে যাওয়ার এক বছর হলেও সংস্কার করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

হাজীপাড়া গ্রামের কৃষক ইউনুছ আলী (৪৫) অভিযোগ করে বলেন, হামরা জন্মের পর থেকে এই রাস্তা দিয়া চলাচল করি। ভাঙা ব্রিজ কোনার জনতে এমন কষ্ট আগোত কারো হয় নাই। এমনি জিনিসপাতির দাম বেশি। মাইনসের মন-মেজাজ ভালো নাই। জীবনটা একেবারে অতিষ্ঠ। তার ওপর যদি আবাদসুবাদের ফসল নিয়্যা হাটবাজারোত যাইতে কষ্ট হয়, তাইলে কেমন লাগে কনতো? একনা রাস্তা, তার ওপর ফির ব্রিজ ভাঙি আছে। কায়ো দেখেও না, খোঁজও নেয় না। মেম্বার চেয়ারম্যানোক কইলে কয় বাজেট নাই।

ওই সড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করা স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী সহিদুল ইসলাম বলেন, রাস্তার ব্রিজটি ভেঙে যাওয়াতে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। বেশিরভাগ মানুষকে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হয়। অটোরিকশা, ভ্যান, কার, মাইক্রো কিছুই এই সড়কের ওপর দিয়ে যায় না। কেউ যদি মোটরসাইকেল নিয়ে যায়, তবুও কষ্ট করে পার হতে হবে। হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতে গিয়ে আমাদের অনেকেই সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পাওে না। দ্রুত সেতুটির সংস্কার করা উচিত।
 
সেতু নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় অল্প সময়ের মধ্যেই সেতুটি ভেঙে পড়েছে বলে দাবি করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) তাজ উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্রিজটি নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে তৈরি। না হলে এতো অল্প সময়ে ভেঙে যাবার কথা নয়। এই ব্রিজের কারণে প্রায় এক বছর যাবত এলাকাবাসী দুর্ভোগে যাতায়াত করছে। আমরা চেষ্টা করছি, তবে বরাদ্দ না থাকায় সংস্কার কাজ করা যাচ্ছে না।

ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইদ্রিস উদ্দিন বলেন, আমি ওই এলাকাটি ঘুরে দেখেছি। যাতায়াতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে সত্য। কিন্তু আমাদের হাতে তো বাজেট নেই। ব্রিজটি সংস্কারের জন্য উপজেলা প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। তবে এখন বাজেটে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করার সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে তারাগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আহম্মেদ হায়দার জামান বলেন, সেতুটি ভেঙে পড়ে আছে। এখনো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ পেলে ওই সেতুসহ পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সড়ক ও সেতু সংস্কার করা হবে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরআই