পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের প্রয়াত ইয়ার উদ্দিন খলিফার (রা.) দরবার শরিফের নামে সারা দেশে প্রায় ৪০ হাজারেরও বেশি দানবাক্স আছে। এসব বাক্সের দায়িত্বে সারা দেশে নিয়োজিত আছেন ১৫৬ জন। আগে তারা টাকা তোলার কাজ করলেও এখন দায়িত্ব নিয়েছেন চুক্তিভিত্তিক।

আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এখনো সাধারণ মানুষ মসজিদের বাইরে অননুমোদিত বিভিন্ন দানবাক্সে টাকা দান করে। ধর্মীয় অনুভূতি, বিভিন্ন ধরনের মুসিবত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার নিয়ত করে তারা এসব বাক্সে দান করেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকের ধারণা নেই টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে অথবা ইসলামে এর বৈধতা আছে কি না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মির্জাগঞ্জের প্রয়াত ইয়ার উদ্দিন খলিফার (রা.) দরবার শরিফ ওয়াকফ এস্টেট হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। মাজার কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে সারা দেশে ৩০ হাজারের বেশি দানবাক্স থাকলেও মূলত রয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি। এসব দানবাক্সের টাকা তোলার জন্য প্রতিটি জেলার উপজেলাভিত্তিক ইজারা দেওয়া হয়। যারা দানবাক্সের টাকা তোলেন, তারা মাজারের মুতোয়ালিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাসিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার হিসাবে সেই এলাকার বাক্সের দায়িত্ব নেন।

পটুয়াখালী শহরে দানবাক্সে টাকা তোলেন মো. কালাম। তিনি বলেন, পটুয়াখালী শহরে আমার ২০০’র মতো দানবাক্স রয়েছে। প্রতিটি বাক্স অনুযায়ী দুই মাস পরপর ১২ হাজার ৬০০ টাকা মাজার কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিই। এই দুই মাসের মধ্যে কম অথবা বেশি পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হলে সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়। আগে মাজার কর্তৃপক্ষের নিয়ম ছিল, যে টাকা দান বাক্স থেকে যা পাওয়া যাবে, তা থেকে একটি অংশ আমরা নেব। সেটা বন্ধ করে দিয়ে তারা ইজারা পদ্বতি চালু করেছে। মানুষ দান যা করুক, লাভ লস সব আমার।

পটুয়াখালীর সদর উপজেলায় দানবাক্সের টাকা তোলেন নজরুল। তিনি বলেন, প্রতি দুই মাসে আমি ২০ হাজার টাকা দিই মাজার কর্তৃপক্ষকে। ৩০০টির মতো বাক্স রয়েছে আমার কাছে। যদি টাকা কম আসে, তাহলে আমি ভর্তুকি দিই। আর যদি বেশি হয়, তা আমার লাভ। আমি ২০০৩ সাল থেকে এই দানবাক্স থেকে টাকা তুলি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়ার উদ্দিন খলিফার মাজারের সাধারণ সম্পাদক শহীদ মল্লিক বলেন, মাজারের দানবাক্স থেকে বার্ষিক তিন কোটি টাকার ওপরে আয় হয়। হিসাবমতে, ৩০ হাজারের ও বেশি দানবাক্স রয়েছে এই মাজারের নামে। আর এই টাকা তোলার জন্য সারা দেশে ১৫৬ জন লোক রয়েছে। তবে বেআইনিভাবে গ্রামগঞ্জে আরও বেশি দানবাক্স ও টাকা ওঠানো হয়। অনেক সময় আমরা পরিদর্শন করি ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। বিভিন্ন এলাকায় ইজারার মাধ্যমে দানবাক্স থেকে টাকা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার বিনিময়ে স্থান অনুযায়ী ৩ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দুই মাস পরপর জমা দিয়ে থাকে। দানবাক্স থেকে যত টাকা আয় হয়, তার পুরো টাকাই ব্যয় হয় এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে।

ইজারার মাধ্যমে টাকা তোলা ইসলামে বৈধ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা মনে হয় ইসলাম ধর্মে নেই। তবে আমাদের আগের কমিটির লোকজন এভাবে টাকা উঠিয়েছে, আমরাও সেভাবে ওঠাচ্ছি। এ ছাড়া এভাবে টাকা না ওঠালে মাজার কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে টাকা পায় না, বিভিন্নভাবে টাকা চুরি হয়ে যায়।

মাজারে দান করাটা ইসলামে বৈধতা আছে কি না, এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা ইমাম পরিষদের সভাপতি মো. আবু সাঈদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো মাজারের দানবাক্সে দান করাই বৈধ নয়। মাজারে দান করার ব্যাপারে ইসলামের বৈধ বিধান নেই। মানুষ কেন মাজারে দান করবে? মাজারে কোনো সংস্কার করার বিষয় আছে কি যে টাকা লাগবে? মাজারে তো কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই। তাহলে মানুষ কেন মাজারে দান করবে?

তিনি আরও জানান, চুক্তিভিত্তিক টাকা সংগ্রহ করা ইসলামের শরিয়ায় অনুমতি নেই। ইসলামের জন্য যিনি সহযোগিতা করবেন, তাকে বেতনভুক্ত করে নির্দিষ্ট কাজ করার বিধান আছে। কিন্তু কোনো চুক্তির কথা নেই। চুক্তিতে কাজ করা বা করানো হারাম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কোনো কমিশন বা কোনো চুক্তির বিষয়ে ইসলাম গ্রহণ করে না।

মরহুম ইয়ার উদ্দিন খলিফার মাজারের সভাপতি মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ফেরদৌসী বলেন, দানবাক্সের বিষয়টি অনেক পুরোনো একটি বিষয়। মাজারের শুরু থেকে এমনটা চলে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে মানুষ দান করেন। আর এটা মাজারের আয়ের প্রধান উৎস, তাই এটা বন্ধ করতে পারছি না। আবার এটার হিসাব রাখতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টিকে ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা যায় কি না। প্রকৃতভাবে যারা দান করেন, সেই অর্থ সরাসরি নিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো। দানবাক্সের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও কাজ চলছে। সামনে আমরা আরও সুন্দর পরিকল্পনা গ্রহণ করব।

এনএ