আগামী ২৫ জুন বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এতে শরীয়তপুরের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীদের মনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এত দিন নিজেরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য পাঠাতে হিমশিম খেলেও এবার স্বপ্ন দেখছেন, আর নয় মধ্যস্বত্বভোগীর দ্বারস্থ হওয়া, এবার নিজেরাই পণ্য সরবরাহ করবেন সারা দেশে।

শুধু জেলার ব্যবসায়ীরাই নন, নতুন উদ্যোক্তারাও স্বপ্ন দেখছেন উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিক্রি করে লাভবান হবেন। জেলার অনেক উদ্যোক্তা মুরগি পালনে ঝুঁকছেন। তারা শেড তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে মুরগি পালন করছেন। পদ্মা সেতু খুলে দিলে মুরগি ও ডিম ঢাকার বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারবেন বলে একবুক আশা নিয়ে আছেন তারা।

সদর উপজেলার নারী উদ্যোক্তা তামিম পোল্টির পরিচালক ফাতেমা বেগম। তিনি স্বাবলম্বী হওয়া ও সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে মুরগি পালন শুরু করেন। শূন্য থেকে শুরু করে তার খামারে এখন ৭ হাজার ডিম পাড়া মুরগি রয়েছে। এতদিনের পরিশ্রমের ফল এখন পাবেন বলে অপেক্ষায় আছেন তিনি।

ফাতেমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছোট-বড় মিলিয়ে নয়টি শেডে সাত হাজার ডিম পাড়া মুরগি রয়েছে। খামারের ডিম শরীয়তপুরের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। এ ছাড়া মাদারীপুর, চাঁদপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ডিম পৌঁছে দেওয়া হয়। পদ্মা সেতু হওয়ায় আমি এবার ঢাকার বাজার ধরতে পারব। এতে আমাদের যেমন ডিম ও মাংসের জন্য মুরগির চাহিদা বাড়বে, তেমনি পোলট্রি খামারিরা কিছুটা হলেও লাভবান হবেন।

ফাতেমার আরও দুটি শেড বন্ধ হয়ে আছে। সেখানে সব ধরনের উপকরণ রয়েছে। পদ্মা সেতু খোলার সিদ্ধান্তে তিনি এবার এ দুটি শেডে মুরগি ওঠাবেন বলে ভাবছেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর প্রথম সুফল যেন আমি পেতে পারি, সে চিন্তায় আছি।

জানা যায়, ভৌগোলিকভাবে শরীয়তপুর থেকে ঢাকার দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার। পদ্মা নদী থাকায় সরাসরি গাড়িতে করে ঢাকা যাওয়া যায় না। ফেরিতে করে পার হয়ে ঢাকায় যেতে হয়। এতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। আবার ফেরির জন্য বসে থাকতে হয়। অপেক্ষমাণ সময় গাড়িতে থাকা মুরগি ও ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাজারে মুরগি পাঠান না। পদ্মা সেতু খুলে দিলে সেই ভোগান্তি আর থাকবে না। সরাসরি বিভিন্ন উপজেলা থেকে গাড়ি ঢাকা যেতে পারবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় প্রতিবছর মুরগির ৩২ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন মাংস ও সাড়ে ১১ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে জেলায় ২০ হাজার মেট্রিক টন মাংসের চাহিদা রয়েছে। ১ হাজার ৪৭৮টি মুরগির খামারে এই মাংস ও ডিম উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে সোনালি ৩৯৯টি, ব্রয়লার ৯৭৭টি ও লেয়ার মুরগির ১০২টি খামার রয়েছে। জেলার প্রায় ৬ হাজার লোক এই পেশার সঙ্গে জড়িত।

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যোগাযোগব্যবস্থার খারাপ ও মুরগি মরার ঝুঁকি থাকায় আমরা ঢাকার বাজার ধরতে পারি না। অন্যান্য জায়গার তুলনায় ঢাকার বাজারে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি বিক্রি হয়। ফেরিতে পরিবহনের খরচ বেশি হয়ে যায়। পদ্মা নদী পার হওয়ার জন্য ফেরিতে অনেক সময় ১০ থকে ১২ ঘণ্টা লেগে যায়। তাই আমরা মাংস ও ডিম ঢাকায় পাঠাতাম না। নোয়াখালী, চাঁদপুর, বরিশালসহ দক্ষিণ অঞ্চলের বেশ কিছু জায়গায় এই উৎপাদিত মুরগি ও ডিম বিক্রি করতে হয়।

কিন্তু পদ্মা সেতু খুলে দিলে যে খরচে পরিবহন করতে হবে, তা আগের থেকে অনেকাংশে কম। আবার মুরগি ও ডিমের দাম বাড়লে আমরা খামারিরা কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বাঁচব। এতে যেমন লাভের সংখ্যা বেশি হবে, তেমনি চাহিদার পরিমাণ বাড়বে।

খামারি ইয়াসদান বেপারী বলেন, আগে যখন আমরা মুরগির ঢাকায় পাঠাতাম, পৌঁছাতেই ২০ থেকে ২৫টি মুরগি গরমে মারা যেত। এ ছাড়া ডিম ভেঙে যেত। দীর্ঘ সময় রাখলে গরমে ডিম পচে যেত। আমাদের লোকসান গুনতে হতো নিয়মিত। পদ্মা সেতু খুলে দিলে মুরগি ও ডিম নষ্ট হওয়ার কোনো ঝামেলা থাকবে না।

মুরগির খামারে কাজ করার শ্রমিক আল আমিন বলেন, আমি রংপুর থেকে এসে এখানে কাজ করছি। এই এলাকায় মুরগি উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু বড় কোনো বাজারে মুরগি ও ডিম পাঠানো যায় না। জেলার ছোট বাজারগুলোয় মুরগি পাঠাতে হয়। এতে মুরগি পালনে যে খরচ, সেই অনুপাতে দাম পান না মালিকরা। পদ্মা সেতু খুলে দিলে মুরগির বাজার বড় হবে। এতে যেমন মালিকের অবস্থার পরিবর্তন হবে, তেমনি আমাদের শ্রমেরও দাম বাড়বে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুবোধ কুমার দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরীয়তপুরে খামারিরা বড় বাজার না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় ভুগছিলেন। পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বাজার তারা ধরতে পারবেন। এতে এত দিন ধরে যে ক্ষতিতে তারা পড়েছেন, তা থেকে নিরসন পাবেন। আবার অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবেন উদ্যোক্তা হতে।

এনএ