দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো ধানের তুষ দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে সিলিকা। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং গ্রামে সাসটেইনেবল এনার্জি অ্যান্ড অ্যাগ্রো রিসোর্স লিমিটেড (সিল) নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই সিলিকা উৎপাদনের কাজ করছে।

সাদা সোনাখ্যাত সিলিকাকে বলা হয়ে থাকে সিলিকন ডাই-অক্সাইড। এটি সাবান, সিরামিক, কাগজ, পেপার বোর্ড, পানি পরিশোধনাগার, ভবন নির্মাণে, গার্মেন্টস পণ্য, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও মেটাল তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশে সোডিয়াম সিলিকেটের বার্ষিক চাহিদা আনুমানিক দুই হাজার মেট্রিক ট্রন পেরিয়েছে। যে হারে শিল্প-কলকারখানা বাড়ছে, এর চাহিদা আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিপুল পরিমাণ সোডিয়াম সিলিকেট (সিলিকা) তৈরির কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর সোডিয়াম সিলিকেট আমদানি করার জন্য অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। সিলিকা তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে দেশের ৫৫ থেকে ৬০ ভাগ সোডিয়াম সিলিকেটের চাহিদা পূরণ করা যাবে। এতে দেশের টাকা দেশেই থাকবে।

পৃথিবীর ভূত্বকের ভর হলো ৫৯ শতাংশ সিলিকা, যা পরিচিত শিলাগুলোর ৯৫ শতাংশেরও বেশি প্রধান উপাদান। সিলিকার তিনটি প্রধান স্ফটিক জাত রয়েছে : কোয়ার্টজ, ট্রিডাইমাইট ও ক্রিস্টোবালাইট। অন্যান্য জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে কোয়েসাইট, কেয়াটাইট ও লেচেটেলিরাইট। সিলিকা বালু পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট, কংক্রিট ও মর্টার, পাশাপাশি বেলেপাথর আকারের ভবন এবং রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। সিলিকা গ্লাস ও পাথর নাকাল এবং পলিশিংয়ে ব্যবহার করা হয়। এটি ছাঁচ, গ্লাস, সিরামিক, সিলিকন কার্বাইড, ফেরোসিলিকন এবং সিলিকন তৈরিতে একটি বিশেষ উপাদান। সিলিকা জেল আর্দ্রতা থেকে পণ্য রক্ষার জন্যও ব্যবহৃত হয়। (সূত্র : এনসাইক্লোপিডিয়া)

সাসটেইনেবল এনার্জি অ্যান্ড অ্যাগ্রো রিসোর্স লিমিটেড থেকে জানা যায়, ধান থেকে চাল প্রক্রিয়াজাত করার পরের বর্জ্যটির নাম হলো তুষ। তুষকে পুড়িয়ে ছাই করলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সিলিকা পাওয়া যায়। এটি কষ্টিক ডাইজেশন করে সোডিয়াম সিলিকেট তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা যায়।

প্রথমে নির্দিষ্ট পরিমাণ ধানের তুষের ছাই মেপে ডাইজেস্টরে নিয়ে কস্টিক সোডা দিয়ে ডাইজেসন (অনবরত নাড়ানো) করা হয়। ডাইজেশন প্রক্রিয়াটি ১০০ থেকে ১৫০ ডিগ্রি সেল তাপমাত্রায় ১ থেকে ২ ঘণ্টা চালানো হয়। এখান থেকে যে ধোঁয়া বের হয়, সেটি বাইরে ছেড়ে না দিয়ে সেটা দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। উৎপন্ন করা বিদ্যুৎ দিয়ে পুরো ইউনিটে সরবরাহ দেওয়া হয়ে থাকে। এতে বাইরে থেকে কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না।

তারা আরও জানায়, এরপর তরল সোডিয়াম সিলিকেট ২ থেকে ৩ মাইক্রন ছাঁকনি দ্বারা ছাঁকা হয়। এতে বিশুদ্ধ তরল সোডিয়াম সিলিকেট পাওয়া যায়। চাহিদা অনুযায়ী সোডিয়াম সিলিকেটে পানির পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য বাষ্পীভবন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানি বাষ্পীভূত করা হয়। এরপর এই বিশুদ্ধ সোডিয়াম সিলিকেট ২৫০ লিটার স্টিলের ড্রামে ভরে বাজারজাত করা হয়। ছাঁকনি হতে প্রাপ্ত বর্জ্য পদার্থ অ্যাক্টিভেটেড কার্বন ড্রাইয়ারের মাধ্যমে শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়।

উৎপান অনুযায়ী বাজারের চাহিদা অনেক পরিমাণে বেশি। স্বল্প সময়ের মধ্যে উৎপাদন বাড়িয়ে বাজার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক প্রকৌশলী মানিক হোসেন বলেন, আমরা ধানের তুষ দিয়ে সিলিকা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করি। যে প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে পরিবেশবান্ধব। পৃথিবীর অল্প কয়েকটি প্ল্যান্টের মধ্যে এটি একটি। আমাদের পুরো প্রক্রিয়াটি শতভাগ পরিবেশবান্ধব। আশা করছি এটির মাধ্যমে আমরা দেশের সিলিকার চাহিদা মেটাতে পারব।

প্রতিষ্ঠানটির ফোরম্যান দুলাল হোসেন বলেন, আমরা এ প্রতিষ্ঠানে ১৭ জন মানুষ কর্মরত আছি। প্রায় ছয় বছর থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আছি। ছয় মাস থেকে আমাদের প্রোডাকশন হচ্ছে। আমরা ধানের তুষ থেকে সিলিকা পাউডার তৈরি করছি পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। যারা কাজ করি, একেকজন একেকটি মেশিন দেখাশোনা করি। আর এখানে সবাই আমরা মাসিক বেতনে কাজ করছি।

প্ল্যান্টটি দেখতে আসা শিক্ষার্থী হাসিনুর রহমান বলেন, প্ল্যান্টটির কথা জানতে পেরে দেখার খুব আগ্রহ ছিল। আজ সরাসরি পুরো প্ল্যান্টটি দেখলাম। সত্যিই এটি প্রশংসার দাবি রাখে। তুষ দিয়ে তারা সিলিকা উৎপাদনের পাশাপাশি এখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পুরো প্ল্যান্টটি পরিচালনা করছে। এটি পরিবেশবান্ধব। ঠাকুরগাঁওয়ে এ শিল্পের প্রসারে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে বলে আমি আশা করছি।

সাসটেইনেবল এনার্জি অ্যান্ড অ্যাগ্রো রিসোর্স লিমিটেডের (সোর্স) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাকসুদুর রহমান বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইডকলের (Infrastructure Development Company Limited (IDCOL)) আর্থিক সহযোগিতায় আমাদের এ প্রজেক্ট। আমরা এ প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন ৫০০ কেজি সিলিকন পার-অক্সাইড পাউডার তৈরি করছি। যেহেতু এটি দেশে পাওয়া যায় না, আমদানি করতে হয়, তাই এটির চাহিদা অনেক বেশি। আমরাই প্রথম দেশে এটি তৈরি করছি। আমরা ধীরে ধীরে এর উৎপাদন আরও বাড়াব।

তিনি আরও বলেন, এক টন ক্যাপাসিটিতে আমরা শিগগিরই যাব। তারপরও এর চাহিদা পূরণ হবে না। আমরা যদি দুই টন তৈরি করতে পারি, তাহলে কিছুটা চাহিদা পূরণ হবে। এতে ইডকল আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি যদি সরকারের সুনজর আসে, তাহলে আরও উৎপাদন করে চাহিদা মেটানো সম্ভব।

এনএ