ছেলে ফরিদের ছবি হাতে মায়ের কান্না

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ছয়দিন পেরিয়েছে। এখনও শনাক্ত হয়নি অগ্নিকাণ্ডে নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের মধ্যে তিনজনের মরদেহ। যাদের একজন হতে পারেন ফায়ার ফাইটার ফরিদুজ্জামান ফরিদ। 

ঘটনার দিন গত শনিবার (৪ জুন) রাতে ফায়ার স্টেশনের পাগলা ঘণ্টা বাজতেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অসুস্থ শরীরে আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন ফরিদ। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান মেলেনি।

ফরিদুজ্জামান ফরিদ রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আদারহাট দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এক মাস আগে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে ফিরে যান কর্মস্থলে। সেখানে সীতাকুণ্ডে আগুন নেভাতে যাওয়া ইউনিটে ছিলেন ২২ বছর বয়সী তরুণ এই ফায়ার ফাইটার। সেদিন রাতের ভয়াবহ বিস্ফোরণে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের লেলিহান থামাতে লেগেছে চার দিন। কিন্তু নিখোঁজ সন্তানের অপেক্ষায় থাকা মা ফুলমতি, ভ্যানচালক বাবা ছাইফুল আর ফরিদের স্ত্রী ইসামণির কান্না এখনো থামছে না।

প্রতিবন্ধী অবুঝ ছোট বোন সাবিহা তার ভাইয়ের ছবি হাতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ফরিদ কথা দিয়েছিল, ছোট বোনের জন্য এবার ঈদুল আজহায় নতুন কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরবে। আর ভ্যানচালক বাবা ছাইফুল মনে স্বপ্ন এঁকেছিলেন, বাবা-ছেলে মিলে নড়বড়ে সংসারকে একটু সাজিয়ে নেবেন। ফরিদ একটু স্বাবলম্বী হলেই ছাইফুল ছেড়ে দেবেন ভ্যানের চাকা ঘুরানো। আসছে ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনে বিবাহত্তোর সংবর্ধনা হওয়ার কথা ছিল ফরিদ-ইসামণির ।

কিন্তু একে একে সব আশার আলো নিভে গেলেও যদি ফিরে আসে, সেই আশায় চেয়ে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা, ছোট বোন আর স্ত্রী। গত সাত দিনে শুধু বেড়েছে দীর্ঘশ্বাস। তারপরও ফরিদের জন্য অপেক্ষায় পুরো গ্রাম।  

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরদিন সীতাকুণ্ডে গিয়ে পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দিয়েছেন ফরিদের ভ্যানচালক বাবা ছাইফুল ও মা ফুলমতি। কিন্তু কবে কখন আসবে ছেলের মরদেহ, তা কারও জানা নেই। এখন ফরিদের খোঁজে গ্রামের কতজন আসে তার বাড়িতে। শুধু আসে না ২২ মাস আগে চাকরিতে যাওয়া ফরিদ।

ছাইফুল ও ফুলমতি দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ফরিদুজ্জামান ফরিদ বড়। তার ছোট বোন সাবিহা আকতার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ৯ মাস আগে সীতাকুণ্ডে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে যোগ দেন ফরিদ। তার আইডি নম্বর ১৪৪১। শনিবার (৪ জুন) রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় আগুন নেভাতে যাওয়া প্রথম ইউনিটে ছিল ফরিদ।

স্বজনরা বলছেন, ফরিদ সম্ভবত বেঁচে নেই। এখনো তো কয়েকজন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মরদেহ শনাক্ত হয়নি। এ কারণে আমরা এখনো ফরিদের অপেক্ষায় আছি। যদি তার মরদেহ পাওয়া যায়, তবুও শেষ দেখাটা হবে।

ফরিদের বড় চাচা আমানুল্লাহ সরকার জানান, ছোটবেলা থেকেই ফরিদ মেধাবী ও শান্ত-নম্র স্বভাবের ছিল। গ্রামের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল তার। পরিবারে দুঃখকষ্ট থাকলেও তার বাবা দিনমজুরি ও ভ্যান চালিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন। বছর দুয়েক আগে অনেক চেষ্টায় সরকারি চাকরিতে ফরিদের সুযোগ হয়। কিন্তু আগুনের ছোবল থেকে অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে এক ফরিদের নিখোঁজে এখন অনেকগুলো জীবন অনিশ্চয়তায় কাতরাচ্ছে।

ফরিদের চাচা তোতা মিয়া জানান, ২২ মাস আগে ফরিদুজ্জামান ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে যোগ দেন। প্রথমে খুলনায় ট্রেনিং নেন। এরপর সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে বদলি হন। স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে কর্মস্থলে ছিলেন ফরিদ।

তিনি বলেন, আমার ভাতিজা গত বছরের ৩ আগস্ট বিয়ে করেছে। এক মাস আগে বাড়িতে এসেছিল। কোরবানির ঈদে এসে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার কথা ছিল। আমাকে বলছিল, চাচা দোয়া করেন একবারে ঈদে আসব। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে আমরা যতটুকু খোঁজ নিয়েছি, তাতে ফরিদ আর বেঁচে নাই।

এদিকে ফরিদের স্ত্রী ইসামণি স্বামীর কথা ভেবে এখনো বিলাপ করছেন। হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে স্বামীকে ফিরে চাচ্ছেন। আর ফরিদের আদরের বোন প্রতিবন্ধী সাবিহা মোবাইলে ভাইয়ের ছবি নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। মা ফুলমতি তার প্রিয় সন্তানের কাপড়চোপড়ে লেগে থাকা গায়ের গন্ধে খুঁজছে ফরিদকে। পরিবারের হাল ধরার একমাত্র ভরসার নিখোঁজে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বাবা ছাইফুল ইসলাম। কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই তাদের।

ঘটনার পর সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশনের ব্যারাক থেকে নিখোঁজ ফায়ার ফাইটার ফরিদুজ্জামান ফরিদের ব্যবহৃত সবকিছু ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো ফেরেনি ফরিদ। সবার চোখ তাই গ্রামের মেঠোপথ আর বাড়ির উঠানের দিকে। সীতাকুণ্ডে পুড়ে যাওয়া মরদেহগুলো অনেকের স্বজন শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। কিন্তু যে তিনটি মরদেহ চেনা যায়নি, ধারণা করা হচ্ছে তাদেরই একজন হতে পারে হতভাগ্য ফরিদ।

১৭ নম্বর ইমাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম ডানো জানান, ফরিদের মা-বাবার অবস্থা ভালো না। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গত রোববার রাতে আত্মীয় স্বজন ও এলাকাবাসীর টাকায় ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সীতাকুণ্ডে গিয়ে ফরিদের মা-বাবা ডিএনএ নমুনা দিয়ে এসেছেন। এখনও ফরিদের সন্ধান বা মরদেহ শনাক্ত হয়নি। তবে আমরা  যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি।

মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, ফরিদুজ্জামান ফরিদের খোঁজে সীতাকুণ্ডের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে তার পরিবারের খোঁজখবর রাখছি। ইতোমধ্যে কিছু সহায়তাও প্রদান করা হয়েছে।

রংপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী জানান, বছর দুয়েক আগে সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ফায়ার ফাইটার (সিপাহী) পদে যোগ দেন ফরিদুজ্জামান ফরিদ। গত শনিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর থেকে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ফরিদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিতে আমরাও উদ্বিগ্ন। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর