ভারতের মুম্বাইয়ে শারীরিক নির্যাতনে আবু রাশেদ নামে এক বাংলাদেশি নাবিকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি জাহান মনির নাবিক ছিলেন। শনিবার (১১ জুন) সকালে কফিনবন্দী অবস্থায় তার মরদেহ যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমারঘাটা গ্রামে পৌঁছায়। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। 

নিহত আবু রাশেদ কুমারঘাটা গ্রামের কৃষক আব্দুস সবুর সরদারের ছেলে। আব্দুস সবুরের দুই সন্তানের মধ্যে রাসেল ছোট।

চলতি বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি জাহান মনিতে ডেক ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন রাশেদ। বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাকাডেমির ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। গত ৩০ মে ভারতের মুম্বাই বন্দরের জলসীমায় নোঙর করা অবস্থায় এমভি জাহান মনি জাহাজে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সেখানকার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ৩১ মে সকালে তার মৃত্যু হয়।

রাশেদের স্বজন, সহকর্মী ও পরিবারের অভিযোগ,  দুই মাস ধরে জাহাজে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় একটি হাসপাতালে রাশেদের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটন করে বিচারের দাবি তুলেছেন পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী।

সকালে রাশেদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পারিবারিক কবরস্থানে রাশেদের মরদেহ দাফনের প্রস্তুতি চলছে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে আসা মানুষের ভিড় বসতবাড়ির মধ্যে। কেউ রাশেদের বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কেউ আবার তার মা পারুল বেগমকে। ছেলের মৃত্যুর খবরে অনেকটা নির্বাক বাবা আব্দুস সবুর সরদার। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ছেলের কফিনের দিকে।

আহাজারি করতে করতে সবুর সরদার বলেন, আমার আব্বুরে কী কষ্ট দিয়ে মেরেছে। মুখে-সারা শরীরে কোনো দাগ ছিল না, এখন সারা শরীর-মুখে দাগ। 

রাশেদের বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজন-প্রতিবেশীরা। বিরামহীন বিলাপ করছিলেন মা পারুল বেগমও। গত কয়েক দিন ধরে অবিরাম কান্নায় তার দুই চোখের সব জল যেন শুকিয়ে গেছে।

কাঁদতে কাঁদতে মা পারুল বেগম বলেন, মৃত্যুর আগের দিন আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে অসুস্থ তারপরও আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেছে- আমি ভালো আছি। তবে রাশেদের কথার স্বর শুনে আমি বুঝে ফেলেছিলাম ও ভালো নেই। আমাদের সব স্বপ্ন শেষ। আমার ছেলেরে না জানি কীভাবে নির্যাতন করে মেরেছে ওরা।

রাশেদের বড় ভাই রাসেলের অভিযোগ, এক মাস আগে রাশেদ তাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘ভাই আমার খুব জ্বর এসেছে। ওরা আমারে চিকিৎসা করাচ্ছে না। ছুটি চাইলে তারা বিভিন্ন অ্যান্টিবায়েটিক দিয়ে আমাকে আরও অসুস্থ করে ফেলছে। তুই দেখ আমাকে কোনোভাবে ছুটির ব্যবস্থা করে দিতে পারিস কি না।’ একপর্যায়ে রাশেদ এমভি জাহান মনির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ছুটি চাইতে গেলে তারা রাশেদকে বলেন, ‘তোর লাশ যাবে এই জাহাজ থেকে, কোনো ছুটি হবে না।’

রাসেল বলেন, রাশেদ কোনো কর্মকর্তার কাছে ছুটি চাইলে ছুটির বদলে তাকে বেশি বেশি ওভারটাইম করাতো। বিভিন্ন ইনজেকশন দিত। ইনজেকশন দেওয়ার ফলে তার রক্তবমিও হতো। দিন দিন শরীর খারাপ হতে থাকলে রাশেদ বুঝতে পারে সে আর বাঁচবে না। তাই গ্রামের আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফোন করে মাফ চেয়ে নিয়েছে। জাহাজে কর্মরত অবস্থায় সমুদ্রে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতকালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করেছে বলে বিভিন্ন সময়ে ফোনে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছে রাশেদ।  আমার ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় সঠিক তদন্ত দাবি করছি। তার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।

এলাকাবাসী জানায়, রাশেদ ছিলেন শান্ত, নিরহংকারী যুবক। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের সবার সঙ্গে মিশতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন। খেলাধুলা করতেন। একাডেমিতে গিয়েও সব ধরনের খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

রাশেদের একাডেমির সিনিয়র সাকিব বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, অনবোর্ড হওয়ার পর থেকেই আবু রাশেদকে কাজের অনেক চাপ দেওয়া হতো। ভোর ৪টা থেকে টানা রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে একটানা ডিউটি করতে বাধ্য করা হতো। এর ফলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে সে জ্বরে আক্রান্ত হয়। জ্বরের জন্য রাশেদকে তিন দিন জাহাজে আইসোলেটেড করা হয়। পরে জ্বর কমলে আবারও প্রতিদিন তাকে ১৬-১৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে বাধ্য করা হয়। গত সপ্তাহে রাশেদ গুরুতর অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে কিছু অ্যান্টিবায়েটিক খেয়ে ডিউটিতে যেতে বাধ্য করা হয়।

তিনি আরও জানান, গত ৩০ মে মুম্বাই বন্দরে জাহাজটি অ্যাংকর লোড করার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যান রাশেদ। এ সময় তার রক্তবমি শুরু হয়। পরে তাকে মুম্বাইয়ের একটি নেওয়া হয়। এরপর ৩১ মে রাশেদ মারা যান। 

নাবিক আবু রাশেদের মরদেহ শনিবার ভোরে তার গ্রামে নিয়ে আসে কর্মস্থল চট্টগ্রামের এসআর শিপিং লিমিটেড। কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম টুটুল জানান, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় গত ৩১ মে রাশেদকে মুম্বাইয়ের জেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। 

রাশেদের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সবই মিথ্যা। কোম্পানি থেকে রাশেদের পরিবারকে যেকোনো সহযোগিতা দেওয়ারও আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।

আরএআর