সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সাক্ষ্যগ্রহণেই আটকে আছে কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের সদস্য পারভেজ হত্যা মামলার বিচারকাজ। মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ। তবে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, চলতি বছরেই শেষ হবে এ মামলার বিচারকাজ।

হত্যা মামলায় সাত বছর আগে সাক্ষ্যগ্রহণের কথা থাকলেও তদন্ত প্রতিবেদন ও সাক্ষীর অভাবে আটকে আছে বিচার কার্যক্রম। এখনো এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এখন পর্যন্ত বাদী কনস্টেবল রাজীব চাকমা ছাড়া কারও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

এ বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরেই শেষ হবে এমামলার বিচারকাজ। নিহত ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্য পারবেজ হত্যা মামলাটি আমি নিজ উদ্যোগে লড়ছি। সাক্ষীর অভাব ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সময় নেওয়ার কারণে দেরি হচ্ছে। এ বছরের মধ্যেই আমরা এ মামলার রায় আশা করছি। যত দ্রুত সম্ভব কক্সবাজার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদলতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে।

নিহত পুলিশ সদস্য পারভেজের বাবা বশির আহমেদ বলেন, সাতটি বছর পার হলে গেল। এখনো বিচার পাইনি। বিচার কার্যক্রমে চলছে ধীরগতিতে। সাতটি বছর আদালতে ঘোরাঘুরি করেছি। ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতায় নতুনভাবে মামলাটি আগাচ্ছে। আমি আশাবাদী ছেলের হত্যার সঠিক বিচার পাব।

২০১৫ সালের ২৩ জুলাই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে লাবণী পয়েন্টের ঝাউবনে এক পর্যটককে ঘিরে ধরে ছিনতাইকারীরা। এ সময় সাদাপোশাকে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ ছিনতাইকারীদের ধরতে গেলে পেছন থেকে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে আহত উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় তাৎক্ষণিক কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার জহিরুল ইসলাম অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করেন। তারা হলেন কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া এলাকার আবুল কালামের ছেলে আবু তাহের (২৮) ও শাহ আলমের ছেলে আবদুল মালেক (২৪)।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আদালতের এক কর্মকর্তা জানান, এই হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। ইতিমধ্যে এই মামলার কয়েকজন আসামি জামিনে বেরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানায়, পারভেজ হত্যা মামালার আসামিদের ধরতে তৎপরতা চলছে। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল করিম বলেন, ১২ জুন পারভেজ হত্যা মামলার বাদী কনস্টেবল রাজীব চাকমা সাক্ষ্য দেন। বাকি সক্ষীদেরও খোঁজ করা হচ্ছে। আমরাও আসামিদের আটকের চেষ্টা চালাচ্ছি।

ঝাউবনে এখনো সক্রিয় ছিনতাইকারীরা
পারভেজ হত্যার পর এখনো ছিনতাইকারীদের দখলে লাবণী পয়েন্টের ঝউবন এলাকা। প্রতিদিন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এতে স্থানীয় ও পর্যটকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক থাকে। গত এক মাসে কক্সবাজার শহরে বড় ধরনের চারটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। প্রায় অর্ধশত স্পটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দাগি অপরাধীসহ ছিনতাইকারী চক্র।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, পর্যটন শহর কক্সবাজার, হোটেল-মোটেল জোন ও সমুদ্রসৈকতে অন্তত শতাধিক পেশাদার ছিনতাইকারী ও ছিনতাই চক্রের টমটম পার্টি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে শহরের দুর্গম এলাকায় আস্তানা গড়ে শহরজুড়ে তৎপরতা চালাচ্ছে এই চক্রটি।

বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া, মোহাজেরপাড়া, বাসটার্মিনাল এলাকা, বাদশাঘোনা, হালিমা পাড়া, সমিতি পাড়া, সার্কিট হাউস এলাকা, হোটেল-মোটেল জোন, লাইটহাউস পাড়া, সাহিত্যিকা পল্লী, পাহাড়তলী, দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া, পেশকারপাড়া ও কলাতলী আদর্শ গ্রামকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। ছিনতাইকারী দলে দলে বিভক্ত হয়ে সমুদ্রসৈকতসহ শহরের বিভিন্ন এলাকার নির্জন স্থানে ছিনতাই করে থাকে। বিশেষ করে ভোরে ও রাতে এরা তৎপর থাকে সবচেয়ে বেশি। এরা নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে বলেও জানান স্থানীয়রা।

আবার পর্যটন মৌসুমে এরা শহরের সমুদ্রসৈকত, ডায়াবেটিকস পয়েন্ট ও ঝাউবাগানসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ওত পেতে থাকে। অন্য সময় এরা বৃহত্তর পাহাড়তলী, হোটেল-মোটেল জোন, রুমালিয়ারছড়া ও ঘোনারপাড়ায় পথচারীদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে থাকে। কেউ বাধা দিলে তাকে ছুরিকাঘাত করে।

কক্সবাজার শহরের বাসিন্দারা প্রশ্ন রেখে বলছেন, যেখানে পুলিশ সদস্য পারভেজ হত্যার পরও ছিনতাইকারী প্রতিরোধ হয়নি, সেখানে আমাদের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়?

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্যসচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, যেখানে ছিনতাইকারীদের হাতে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পাঁচ বছর ধরে বিচারকাজ ঝুলে আছে, সেখানে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সাধারণের বিচারপ্রাপ্তি তো দুঃস্বপ্নের মতো। অপরাধীদের নজরদারি করার পাশাপাশি বিচারের সঠিক প্রয়োগ না হলে অপরাধীরা নানা অপরাধে উৎসাহিত হবে।
 
পুলিশ সদস্য পারভেজ হত্যায় যারা জড়িত, তাদের দ্রুত সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে পর্যটন শহরে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা হলেও কমবে।

জেলা পুলিশ বলছে, শহরের দাগি ও চিহ্নিত অপরাধীদের বহুবার আটক করা হয়েছে। এসব অপরাধীরা সহসাই জামিনে বেরিয়ে আসার কারণে কিছু বিছিন্ন ঘটনা ঘটছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, আসামিদের আটকের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আসামিরা আত্মগোপনে থাকায় তাদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

সাইদুল ফরহাদ/এনএ