উজানের ঢল আর অব্যাহত বর্ষণে টইটম্বুর তিস্তার পেট। আষাঢ়ের শুরুতেই হু হু করে বাড়ছে তিস্তা নদীর পানি। বিপৎসীমা ছাপিয়ে পানি ঢুকে পড়েছে নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে। তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা কাটাচ্ছে নির্ঘুম রাত। পানি প্রবাহ বেড়ে তলিয়ে গেছে বাদাম, মরিচ, পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়া ও ভুট্টাসহ বিস্তীর্ণ চরের বিভিন্ন উঠতি ফসল। অন্তত ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ হাঁটু বা কোমর পানিতে বন্দী দশায় আছেন। এসব মানুষের হাতে এখনো পৌঁছেনি কোনো সহায়তা।

দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে ৪৪টি স্লুইসগেট খুলে রাখা হয়েছে। পানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার চর এলাকাগুলো প্লাবিত হতে শুরু করেছে। টানা বৃষ্টিপাতে তিস্তা ছাড়াও মানাস, টেপা, ঘাঘট, করতোয়া, যমুনেশ্বরী, আখিরা-মাচ্চা নদীসহ জেলার অন্যান্য নদ-নদী ও খাল-বিলে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ক্রমেই বাড়ছে দুর্ভোগ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল ৯টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। আর তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে আবারও বিপৎসীমা উপচে যাবে।

শুক্রবার সকালে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী, নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, গজঘণ্টা ও মর্নেয়া, কাউনিয়ার বালাপাড়া, পীরগাছার ছাওলা, তাম্বুলপুর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিস্তায় হু হু করে পানি বাড়তে থাকায় চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের বাদামসহ বিভিন্ন ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। হাজারো বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। অনেক জায়গায় এখনো হাঁটু ও কোমর সমান পানি। সম্ভাব্য ভাঙন ঠেকাতে এসব জিও ব্যাগ আগাম মজুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। এ ছাড়া বিনবিনিয়ায় দুটি স্থানীয়দের দেওয়া বাঁধ আটকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাশের স্পার ও জিও টিউব ব্যাগ ফেলছে।

প্লাবিত এসব এলাকার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, বাঁশের সাঁকোসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিবর্ণ তিস্তাপাড়ের মানুষদের চোখে কয়েকদিন থেকে ঘুম নেই। কখন কী হয় সে চিন্তাই এখন মনে ভর করেছে তাদের। সঙ্গে হাড়ভাঙা শ্রমের ফসলি খেত পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পূর্ব ইচলি গ্রামের কালা মামুদ বলেন, ‌‌কয়দিন থাকি নদীত পানি বাড়তে আছে। তাতে ফির আইত (রাত) হইলে বৃষ্টি। হামরা বউ-ছাওয়া নিয়্যা খুব কষ্টোত আছি। কয়দিন থাকি ঠিক মতো ঘুম হওচে না। ভয় নাগে, কখন কী হয়। অ্যালাও তো হামরা হাঁটু পানিত আছি। কোন্টে কোনা রান্দিবারি খামো, সেই জায়গাও নাই। চকির ওপররোত চকি দিয়া কোনোমতে আইত কাটাওছি।

একই এলাকার সোহরাব, জয়নাল, টেপা মুন্সিসহ আরও বেশ কয়েকজন জানিয়েছে, ইউপি চেয়ারম্যানের উদ্যোগে পানিবন্দি বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশুদের নৌকায় করে উঁচু স্থানে নেওয়া হয়েছে। বন্যা এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো তারা কোনো ত্রাণ সহায়তা পায়নি।

লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের শংকরদহ ও বাগেরহাট এলাকার বাসিন্দা ফিরোজুল, রফিক ও আব্দুল মতিন মিয়া। তিস্তা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় অন্যদের মতো চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। এখন নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে সৃষ্ট ভাঙনে আতঙ্কিত এই তিন কৃষক অনেক কষ্টে তাদের বাড়িঘর উঁচু জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন।

কৃষক ফিরোজুল মিয়া জানান, সারাজীবন কষ্ট আর কষ্ট। নদীপাড়োত জন্ম নেওয়াটাও হামার অপরাধ। সরকার চাইরোপাকে (সবখানে) উন্নয়ন করে, খালি হামার তিস্তা নদীর কিছু করে না। কত দিন ধরি শুনোছি ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি হইবে। কিন্তু কামের কাম কিছুই হয় নাই। অ্যালা (এখন) ফির চীনের সাথে নাকি সরকার নদী শাসন (তিস্তা মহাপরিকল্পনা) করবে। বছরে বছরে কত কথা শুনি, হামার এত্তি কোনো কাম চোখোত পড়ে না বাহে।

ওই  ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি গ্রামের পানিবন্দি সামিনা বেগম, বৃদ্ধা ফাতেমা বেওয়াও ক্ষুদ্ধ তিস্তার বুকে পানি বাড়তে থাকায় টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দুর্ভোগে থাকা এই দুই নারীর মতো অন্যদেরও অভিযোগের শেষ নেই। কয়েকদিন ধরে পানিবন্দি থাকা এসব মানুষ চুলোয় আগুন জ্বালাতে পারছে না। তাদের অনেকেরই দু’বেলা খাবার মতো ব্যবস্থাও ফুরিয়েছে। এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান-মেম্বার কারও কাছ থেকে কোনো খাদ্য সহায়তাও মেলেনি।

ওই গ্রামের পানিবন্দি নাসিমা বেগম জানান, নদী ভাঙতে ভাঙতে তার বাড়ির উঠানে চলে এসছে। এখন বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাকে নৌকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান। এ যুদ্ধ শুধু লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নে নয়, তিস্তা অববাহিকার সবগুলো জেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ প্রতিবছর দুর্যোগ-দুর্ভোগের সাথে লড়াই করে এভাবেই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করছেন।

লক্ষীটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি জানান, ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে যাওয়ায় আমরা মাইকিং করে বয়স্ক, অসুস্থ নারী-পুরুষ এবং শিশুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ইতোমধ্যে নৌকা দিয়ে অনেককে উঁচু স্থানে নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত পানিবন্দি কোনো মানুষকে আমরা সহযোগিতা করতে পারিনি। তবে ইউএনও মহোদয়কে জানানো হয়েছে। কিন্তু সাহায্য এখনো পাওয়া যায়নি। তার ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ডের অন্তত ১০ হাজার বাড়িঘর হাঁটু বা কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে।

গজঘন্টা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, প্রতিদিনই তার ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। মানুষ পানিবন্দি হচ্ছে। বাদামের সব ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত খাদ্যসামগ্রী বিতরণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডের প্রায় ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পানির তোড়ে অনেক স্থানে রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। দুর্গত এলাকায় মানুষ খুবই বিপাকে পড়েছেন। বিনবিনিয়াচরের পশ্চিমপাড়ায় বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ, বাঁশঝাড়, জমি, বসতবাড়ি। বেড়িবাঁধটির পূর্বের অংশ এরই মধ্যে ভেঙে গেছে। এখন খৈখাওয়া অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যদি এই ভাঙন রোধ করা না যায়, তাহলে খৈখাওয়া, পাঙ্গাটারি, মধ্যপাড়া, আমিনগঞ্জসহ আশপাশের প্রায় ১১ থেকে ১২টি গ্রামে ভাঙন দেখা দেবে। 

নোহালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ জানান, ওই ইউনিয়নের ১৬ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে মর্নেয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান জানান, প্রায় ৩ হাজার মানুষ পাবিবন্দী হয়ে পড়েছেন। তিনিও এখন পর্যন্ত কাউকে কোনো খাদ্য সহায়তা দিতে পারেন নি।

প্রতিবছর আকস্মিক বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চলের হিডেন ডায়মন্ড খ্যাত কৃষি ও কৃষকরা। জরুরিভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভুর্তকি কিংবা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না গেলে এই অঞ্চলে মহাবিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যর্থতা ও সরকার ঘোষিত তিস্তা নিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ এ অঞ্চলে প্রতিবছর ক্ষয়ক্ষতি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে গত বছরের বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বর্ষা মৌসুমের আগেই তিস্তা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। এখন তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি খেতসহ অনেকের বসতভিটা তিস্তার পেটে চলে গেছে।

তিনি আরও বলেন, এবারের বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি তিস্তার বালুর চরে চাপা পড়ে নষ্ট হয়েছে। নদীপাড়ের মানুষেরা এখন ঘরহারা, ভিটাহারা, উদ্বাস্তু। জরুরিভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভুর্তকি কিংবা পুনর্বাসনের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। না হলে কৃষিনির্ভর তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে মহাবিপর্যয় দেখা দেবে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানিয়েছে, উজানের ঢল আর অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘটসহ এ অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বাড়তে থাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে নীলফামারীর জলঢাকা, ডোমার, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, লালমনিরহাট সদর, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, রৌমারী, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা ও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলোতে পানি ঢুকে পড়েছে।

রংপুরে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, ভাঙনকবলিত কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনিয়া চর ও লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ক্ষতির মুখে। তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। টেকসই-মজবুত বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি সমীক্ষা করা হচ্ছে। সমীক্ষা প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তিনি আরও জানান, তিস্তার ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। তবে শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল ৯টায় তা ৫ সেন্টিমিটার নীচে নেমে আসে। এখনো ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হলে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে আবারও বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। এ কারণে চর ও নিম্নাঞ্চল এলাকার বাসিন্দাদের উঁচু স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ১১৯ দশমিক ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকবে। 

আরআই