‘স্ত্রীর দুইটা কিডনি নষ্ট। প্রতি সপ্তাহে তিন হাজার টাকা লাগে ওষুধের জন্য। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ, ভরণপোষণ— সবকিছুর বোঝা নিয়ে বাসায় কি শুয়ে থাকা যায়? বাপের মাথায় সকলের দায়িত্ব থাকে। বাপ হোন, তাহলে বুঝবেন। বাপেরা বোঝে তাদের মাথায় কত বোজা। কত কিছুর বোঝা নিয়ে যে জীবনসংগ্রাম চালাতে হয়, তা একমাত্র বাবারা জানে।’

ঠাকুরগাঁও পৌরসভার কলেজপাড়ার বাসিন্দা মনিরুল ইসলামের মনের কথাগুলো এমন। পা হারানো অটোচালক মনিরুলের পরিবারে স্ত্রী-সন্তানসহ ছয় সদস্য। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি তিনি। একটি পা না থাকলেও পরিবারের ভরণপোষণ ও স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ জোগাতে অটো নিয়ে বের হতে হয় তাকে।

তিন মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে তার। বড় মেয়ে সাবিনা আক্তার ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়েন। দ্বিতীয় মেয়ে সেলিনা আক্তার ও একমাত্র ছেলে মারুফ জামান ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন। সবার ছোট সাদিয়া দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।

একসময় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মনিরুল। সৎ পথে চলতে গিয়ে কিছু মানুষের চক্ষুশূল হয়ে যান। তাদের আক্রমণে ডান পা হারাতে হয় তাকে। পায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তিন মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর যখন অভাব শুরু হয়, তখন আর ঘরে বসে থাকেননি ৷ একটি অটোরিকশা কিনে নেমে পড়েন রাস্তায়। সেই অটো চালিয়ে এখন তার ছয় সদস্যদের সংসার চালান তিনি।

মনিরুল ইসলামের দ্বিতীয় মেয়ে সেলিনা আক্তার বলেন, আমার বাবাকে নিয়ে কিছু বলার নেই আমার। আমার বাবা সুপার হিরো। এক পা দিয়ে যুদ্ধ করেন আমাদের জন্য। এমন যোদ্ধা খুব কম আছে। তিনি কখনো নিজের জন্য চিন্তা করেন না। টাকার অভাবে আমাদের পড়াশোনা কখনো থামাতে দেননি। প্রতিদিন আমাদের সুখে রাখার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আমার বাবার সর্বদা সুস্থতা কামনা করছি।

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, একসময় চাকরি করতাম আজ অটোরিকশা চালাই। এতে আমার কোনো আফসোস নেই। আর আফসোসই বা কেন করব, আজ যে পরিশ্রম করছি ঝুঁকি নিয়ে সব আমার পরিবারের জন্য। তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারলেই নিজের সব দুঃখ ভুলে সুখ খুঁজে পাই। আমি যে সাদা পাঞ্জাবিটা পরে আছি, এটার বয়স বললে আপনি অবাক হবেন, কিন্তু সন্তানদের ঈদে নতুন কাপড় দিয়েছি। তবু সব মিলিয়ে আল্লাহ ভালোা রেখেছেন। সকলে দোয়া করবেন আমাদের জন্য।

একই অবস্থা নিয়ে জীবন যুদ্ধ করছেন পৌরসভার গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা নুর ইসলাম। বছর চারেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁ পা হারান তিনি। পায়ের চিকিৎসা করাতে হারাতে হয়েছে ভিটেমাটি। ছোট দুই শিশুসন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন ভাড়া বাড়িতে। ঝুঁকি নিয়ে একজনের দান করা অটোরিকশা চালিয়ে নিজের খরচ ও সংসারের খরচ জোগান দিচ্ছেন তিনি।

নুর ইসলাম বলেন, যাদের সন্তান বাসায় আছে, তারা কখনো সন্তানের কান্না সহ্য করতে পারে না। আমার পা নেই, মানুষ ভিক্ষা করতে বলে। কিন্তু আমি ভিক্ষা করব না ইনশা আল্লাহ। সকালে এই অটোরিকশাটা নিয়ে বের হই। ওঠানামা করতে পারি না। ধীরে ধীরে গাড়ি চালাই। সারা দিনে ৫০০ টাকা হলে আমি বাসায় চলে যাই। কারণ এতক্ষণ থাকার পর শরীর আর চলে না, অস্বস্তি বোধ করি। যেহেতু এখনো প্রতিদিন আমাকে ওষুধ খেতে হয়।

তবে কোনো বাবাই পরিবার বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা করেন না কখনো। সব সময় চিন্তা করেন নিজের পরিবার ও সন্তানের চাহিদা পূরণ করতে হবে কীভাবে। আমার জন্য দোয়া করবেন, যাতে এভাবে সারা জীবন চালিয়ে নিতে পারি। পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারি। কারণ আমি থেমে গেলে পরিবার থেমে যাবে।

এনএ