মাথার ওপর আষাঢ়ের মেঘ ভাঙা রোদ। সেই রোদ ভেদ করে যাচ্ছে পলিথিনের অস্থায়ি ছাউনি। আর সে ছাউনির নিচে বসেই অবিরাম হাপর টেনে চলেছেন চশ্লিশোর্ধ হারাধন কর্মকার। হাপরের টানে ধীরে ধীরে জ্বলছে কয়লা। এক সময় স্ফুলিঙ্গ লকলকিয়ে বেরিয়ে এল। সেই আগুনেই পুড়তে পুড়তে এক সময় লাল হলো লোহা। 

সেই লোহাতে বাবা-ছেলের হাতুড়ি পেটা চলল কিছুক্ষণ। এরপর তৈরি হলো লোহা কাটা ছেনি। আগুনে লোহা পুড়িয়ে নানা হাতিয়ার বানান পেশায় কর্মকার হারাধন। বংশ পরম্পরায় এটিই তার পেশা।

হারাধন কর্মকার রাজশাহী নগরীর সুজানগর শিল্পীপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার জন্ম নওগাঁর পোরশা উপজেলার নুছনাহার গ্রামে। জীবিকার সন্ধানে শহরে এসে থিতু হয়েছেন তিনি। ইট-কাঠের এই শহরে দীর্ঘদিন পরিবার নিয়ে ভাসমান ছিলেন। এখন তার ঠিকানা হয়েছে। গড়ে তুলেছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই। আর এ সবই হয়েছে লোহা পিটিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে।

নগরীর শাহমখদুম থানার মোড় এলাকায় রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশেই হারাধনের অস্থায়ী কামারশালা। সেখানেই পাওয়া গেলো হারাধন কর্মকারকে। আসছে কোরবানির ঈদ। পশু জবাইয়ের প্রস্ততি হিসেবে লোকজন ধার দিচ্ছেন হাতিয়ারে। কেউ কেউ নতুন নতুন ছুরি-চাকু, দা, হাঁসুয়া, বটি বানাচ্ছেন।

এখন কিছুটা ব্যস্ততা বেড়েছে হারাধনের। কর্মচারী নেই তার। তাই ছেলে চন্দন কর্মকারকে (১৯) সঙ্গে নিয়ে হাপর টেনে চলেছেন তিনি। চন্দন রাজশাহী সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থী। ১৯ জুন থেকে তার এসএসসি শুরু হবার কথা ছিল। সিলেটে বন্যার কারণে পরীক্ষা স্থগিত। তাই সকাল থেকেই বাবার সঙ্গে চন্দন। ৯ বছর বয়সী এক কন্যারও বাবা হারাধন।

কাজের ফাঁকে কথা হয় বাবা-ছেলের সঙ্গে। হারাধন জানান, তার বাবা লক্ষ্মীকান্ত কর্মকার এই পেশায় ছিলেন। তারও আগে দাদাসহ পূর্বপুরুষরা এই পেশায় ছিলেন। মাঝেমধ্যেই বাবার কাজে তিনি সাহায্য করতেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। দশ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। ওই টুকু বয়সে তাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়।

জীবিকার সন্ধানে বছর বিশেক আগে তিনি রাজশাহীতে আসেন। শুরুর দিকে অন্যের কামারশালায় কাজ নেন। একটা সময় নিজেই কামারশালা দেন। তিনি বাপ-দাদার পেশায় থাকলেও ছোটো ভাই দিনেশ কর্মকার পেশা বদলে স্বর্ণকার হয়েছেন। পোরশার নুছনাহার বাজারে তার স্বর্ণকারের দোকান রয়েছে।

হারাধান আরও জানান, ব্যবসায় ওঠানামা আছে। কখনো ভালো চলে, কখনো মন্দ। রোজ সকাল ৭টায় আসেন, ঘরে ফেরেন সন্ধ্যায়। সারা দিনে কখনো ২০০ তো কখনো ৫০০ টাকা আয়। আবার কোনো কোনো দিন খালি হাতেই ফিরতে হয় ঘরে।

তার স্থায়ী দোকান নেই। রাস্তার পাশে হাপর বসিয়ে কারবার চালিয়ে আসছেন। রাস্তা প্রশস্ত করার সঙ্গে সঙ্গে বার বার জায়গা বদলেছে তার। কিন্তু প্রায় দুই দশকে এই এলাকাতেই রয়ে গেছেন। তবে এবার পিট ঠেকেছে দেয়ালে। আর পিছু হটার জায়গা নেই। ফুটপাত হলে তাকে অন্যত্র সরে যেতে হবে। পরে কী হবে এই ভাবনা এখন ভাবতে চাননা হারাধন।

তার ভাষ্য, লোহার দাম বেড়েছে। ব্যবসা হয়ে পড়েছে মৌসুমি। কোরবানির সময় কিছুটা বিক্রি হলেও বছরজুড়ে ব্যবসা থাকে না। ফলে সবমিলিয়ে দ্রব্যমূল্যের বাজারে টিকে থাকা কষ্টকর। সরকারের তরফে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানা সংকটে প্রণোদনা পেলেও তারা পাননি। ফলে কঠিন সময় পার করছেন তারা।

পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় শ্রমিক রাখতে পারেন না। ফলে ছেলেকে নিয়েই কাজে নামতে হয়েছে। নিজে আগুনে পুড়লেও ছেলেকে এই আগুনে পোড়াতে চান না হারাধন। তিনি বলেন, ছেলে পড়ালেখা করছে। আমি চাই, পড়ালেখা শেষ করে সে চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হোক। দুধে-ভাতে থাকুক।

বাবার স্বপ্ন পুরণ করতে চায় চন্দন। তার ভাষ্য, পড়ালেখার পাশাপাশি ওয়েল্ডিং এবং ইলেকট্রিক মেরামতের কাজ শিখেছে। তার প্রথম লক্ষ্য পড়ালেখা শেষ করে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিতে যাওয়া। চাকরি না পেলে প্রশিক্ষণের ওপরে ভর করে কিছু একটা করা। সেটাও না হলে শেষে বাবার পেশাতেই নামার লক্ষ্য তার।

ছেলে চন্দরের চোখে বাবা সমসময় সুপার হিরো। পৃথিবীর সেরা বাবা। টানাপোড়েনের সংসার, তবুও কখনো তার কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখেননি বাবা। তাই বড় হয়ে বাবার মুখে হাসি ফোটাবে চন্দন।

আরআই