বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় একটি বছর ১৯৮৮ সাল। দেশের ইতিহাসে ওই বছরে ঘটে যায় ভয়াবহ বন্যা। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সংঘটিত ওই বন্যায় প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। ১৫ থেকে ২০ দিন ধরে চলা ভয়াবহ এ বন্যায় বাদ পড়েনি উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও।

সে বন্যায় জেলার মানুষ যখন সব হারিয়ে দিশেহারা, খুঁজছিল একটুখানি আশ্রয় আর খাবার, তখন নিজ এলাকার এমন অবস্থা দেখে বসে থাকতে পারেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শহীদউজ্জামান। এলাকায় এসে কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন আর্তমানবতার সেবা।

ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করেন ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে। এরপর বন্ধুরা মিলে টাকা তুলে খাবারের ব্যবস্থা করেন দিশেহারা বানভাসি মানুষদের জন্য। ধীরে ধীরে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। কিন্তু বন্যাকবলিত মানুষের জীবনযাপন হয়ে পড়ে কঠিন।

তখন মাত্র নয় বন্ধু মিলে তৈরি করেন আর্থসামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। শূন্য থেকে শুরু হওয়া সেই প্রতিষ্ঠানটি আজ হাজারো মানুষের আস্থার জায়গা। এ প্রতিষ্ঠানে এখন কর্মরত আছেন ছয় হাজারেরও অধিক মানুষ। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য আস্থার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে।

ঠাকুরগাঁও পৌরসভার কলেজপাড়ার বাসিন্দা শহীদউজ্জামান ঠাকুরগাঁও জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি। বর্তমানে নিজ প্রতিষ্ঠান ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মানবসেবায় ব্রত হওয়া সেই প্রতিষ্ঠানের শুরুর গল্প, নিজের ইচ্ছা ও ভালো লাগার অভিব্যক্তি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ঢাকা পোস্টকে। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

ঢাকা পোস্ট : শৈশব কোথায় কেটেছে আপনার?

ড. শহীদউজ্জামান : ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার রাজবাড়ীতে আমার জন্ম। শৈশবের পুরোটা সেখানেই কেটেছে। আমার বাবা যেহেতু সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে পরে আমরা শহরে চলে আসি। স্কুলজীবন শুরু হয়েছে ঠাকুরগাঁও বুলবুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।

ঢাকা পোস্ট : আপনার সময়ের মানুষের জীবনযাপন কেমন দেখেছেন?

শহীদউজ্জামান : আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে রাণীশংকৈলে। তারপর আসা ঠাকুরগাঁওয়ে। সেই সময়ে মানুষের কষ্টের সময় ছিল। সেখানে রাজবাড়ীর পাশে মাহুতপাড়া নামে একটি গ্রাম আছে। অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের বসবাস ছিল সেখানে। শহরের কলেজপাড়ায় আমরা থাকতাম, সেখানেও আশপাশে দরিদ্র মানুষের বসবাস ছিল। জেলার প্রায় অধিকাংশ এলাকায় দারিদ্র্যের কশাঘাত অবস্থা ছিল। আমি দেখেছি বাংলা কার্তিক, ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে মানুষ তিন বেলা খাবার খেতে পারত না। সেখান থেকেই একধরনের আকাঙ্ক্ষা ছিল যদি কখনো সুযোগ হয়, এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করব।

ঢাকা পোস্ট : পড়াশোনা চলাকালীন ঢাকা থেকে কেন ঠাকুরগাঁওয়ে চলে এসেছিলেন?

শহীদউজ্জামান : আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন ছিল ১৯৮৮ সাল। সে সময় বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয়। আমাদের জেলা বন্যাপ্রবণ এলাকা নয়। তবু সেবার আমাদের এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়। আর বন্ধের সময় আমি এসে দেখলাম বন্যাদুর্গত মানুষের অবস্থা শোচনীয়। তখন আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা তাদের ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে আবাসনের ব্যবস্থা করি। যদিও কলেজ কর্তৃপক্ষ সম্মতি দেয়নি। তারপর আমরা তাকে বুঝিয়ে ২৫০ পরিবারকে সেখানে নিয়ে গেলাম। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। নানাভাবে চেষ্টা করে সীমিত অর্থ দিয়ে দু-এক দিন চালিয়েছিলাম। পরে কিছু সংগঠন সেখানে সহযোগিতা করেন।

ঢাকা পোস্ট : ইএসডিওর যাত্রা শুরু হলো কীভাবে?

শহীদউজ্জামান : বন্যা-পরবর্তী লোকজন যখন ফেরত গেল। বিভিন্নভাবে আমরা যেহেতু তাদের সাহায্য করেছিলাম, পরে তারা আমাদের কাছে অনুরোধ করল তাদের আরও কিছু সাহায্য দরকার। সেই চেষ্টা থেকে আমরা তাদের ফসলের বীজ কেনার জন্য সহযোগিতা করি। কৃষি পুনর্বাসন করার জন্য আমরা বন্ধুরা মিলে ১৪ হাজার টাকা তুলে ২৮টি পরিবারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করি। পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য ফ্রি কোচিং সেন্টার চালু করি, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করি। এভাবে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাসেবী কাজটা আরও প্রসারিত হয়।

পরে অনেক পরামর্শ দিল একটি প্রতিষ্ঠান করলে অনেক সুবিধা হবে। তখন আমরা সরকারি সমাজসেবা বিভাগে অবেদন করে রেজিস্ট্রেশন নিই৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংস্থা, দাতা সংগঠন এখানে সহায়তা করা শুরু করে। ধীরে ধীরে এটি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আমি স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম হই। কিন্তু মনে হয়েছে মানুষের কাছাকাছি না গেলে তারা পিছিয়ে পড়বে। আমি যদি চাকরিতে যাই, তাহলে সব বিঘ্নিত হবে। তাই নয়জন মিলে এ প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করি।

ঢাকা পোস্ট : পড়াশোনা চলাকালীন এমন উদ্যোগে কি পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটেছিল?

শহীদউজ্জামান : যেহেতু ছাত্র হিসেবে আমার ভালো একটি পরিচিতি ছিল, এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফল ভালো ছিল, তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভালো ফলের সম্ভাবনা ছিল, সব মিলিয়ে আমার কাছে অসহায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশাটা অগ্রাধিকার ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি অতিরিক্ত যে সময় পেয়েছি, সে সময়টা মানুষের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলে পড়াশোনা করা সার্থক হবে, এটাই ছিল লক্ষ্য।

ঢাকা পোস্ট : মানবসেবা কি পড়াশোনার অন্তরায় হতে পারে?

শহীদউজ্জামান : সবার আগে জানা দরকার আমরা কেন শিক্ষা গ্রহণ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, শিক্ষা মানুষকে মুক্তি দান করে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে পড়াশোনার অংশই হলো মানুষের পাশে থাকা। আমরা যে বিষয়েই পড়াশোনা করি না কেন, এর মানেই হলো মানুষের পাশে থাকা। পড়াশোনার অর্থ যদি এমন হয় যে শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমাকে লাভবান করবে কিন্তু সমাজ উপকৃত হবে না, তাহলে এই পড়াশোনা আমার কাছে জরুরি বলে মনে হয় না।

ঢাকা পোস্ট : ইএসডিওতে বর্তমানে কতজনের কর্মসংস্থান হয়েছে?

শহীদউজ্জামান : যখন আমরা স্বেচ্ছাসেবী কাজগুলো করতাম, তখন আমরা ১৪ বন্ধু ছিলাম। অনেকেই পরে সরকারি চাকরিতে চলে যায়। আনুষ্ঠানিক শুরু করেছিলাম নয়জন মিলে। বর্তমানে ৪৯টি জেলা ও ২৮২টি উপজেলায় ইএসডিওতে সাড়ে ছয় হাজার সহকর্মী কাজ করি। সারা দেশে ৩১২টি অফিস রয়েছে। চলমান প্রকল্প হলো ১১৮টি৷ এ কার্যক্রমগুলোর সঙ্গে সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ৪২টি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্ব রয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : অনিশ্চিত বিষয়কে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পরিবারের সমর্থন কেমন ছিল?

শহীদউজ্জামান : আমার বাবা ও দুই ভাই সরকারি চাকুরে ছিলেন। ভাইদের চেয়ে আমার রেজাল্ট ভালো ছিল। সে কারণে সবাই ভাবত আমিও সরকারি চাকরিতে যোগ দেব। যখন আমি এদিকে মনোনিবেশ করি, পরিবার আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। আমার সহধর্মিণী ও আমি একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। তারও ইচ্ছা ছিল মানুষের জন্য কাজ করা। মানুষের সঙ্গে থেকে নিজের সুখ খুঁজে পাওয়া। আমি মনে করি অনিশ্চিত এ জীবনের জন্য পরিবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। বরং তারা আমাকে অনেক উৎসাহিত করেছে।

ঢাকা পোস্ট : বর্তমান প্রজন্ম সরকারি বা স্থায়ী চাকরির পেছনে ছুটছে। কেউ অনিশ্চিত পেশা বেছে নিতে চায় না। এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শহীদউজ্জামান : জীবনের দর্শনটা একেকজনের কাছে একেক রকম। আমি মনে করি আজ চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণরা ভালো উদ্যোক্তা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উৎসাহিত হওয়ার মতো বিষয়। শুধু চাকরির পেছনে ছোটা বোধ হয় বেশি প্রয়োজন নেই। যেহেতু দেশে এখন ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। যদি তরুণরা চাকরি বাদ দিয়ে সৃজনশীল কাজে যুক্ত হয়, তাহলে তাদের ক্যারিয়ার আরও ভালো হবে। এভাবে সে নিজে উপকৃত হবে, দেশকে সমৃদ্ধ করবে।

ঢাকা পোস্ট : যেসব তরুণ বেকার আছেন, তাদের উদ্যোক্তা হতে আপনাদের কোনো প্রকল্প আছে কি না?

শহীদউজ্জামান : এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল কুড়ি বছর। সেই নয় থেকে আজ হাজার পেরিয়েছে। মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তরুণদের সহায়তা ও সমর্থন দেওয়ার জন্য একটা ছোট পরামর্শ থাকবে। সেটি হলো যে ‘সফল হওয়ার জন্য কোনো শটকাট মেথড নেই’। আগে সুদৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি কিছু করতে চাই। এটি বাস্তবিক রূপ দিতে ইএসডিও নানামুখী কাজ করছে।

আমাদের দেশে প্রায় ১১টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট আছে। আমরা প্রতিবছর তিন হাজার তরুণকে তাদের ১৭টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। সেই সঙ্গে তাদের আমরা স্টার্টআপ ক্যাপিটেল আমরা একটা সাপোর্ট দিই। তার কাজের যে প্রোডাক্ট, সেটি যাতে সে বিক্রি করতে পারে, সে জন্য আমরা ডিজিটাল মার্কেটিং ও ফিজিক্যাল মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকি। আর তরুণদের ক্ষেত্রেও আমাদের কাজ রয়েছে।

যারা গবেষণা করে, নতুন কিছু নিয়ে ভাবে, সৃষ্টিশীল তৈরি করার চেষ্টা করে, তাদের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট আছে। এখান থেকে নানা বিষয়ে গবেষণা করে কেউ দেশের বাইরে গেছে, কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে, কেউ উদ্যোক্তা হয়েছে। এ প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া কেউ উদ্যোক্তা হতে কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন হলে আমরা প্রস্তুত আছি। এটাকে ইএসডিও মূল দায়িত্ব মনে করে।

ঢাকা পোস্ট : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

শহীদউজ্জামান : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।

এনএ