• মৎস্য খাতে ক্ষতি প্রায় ২ কোটি টাকা
• বন্যার কবলে ১৩৯০০০ পশু-পাখি
• পানির নিচে ১৫৩২০ হেক্টর আবাদি জমি
• পাঁচ জেলায় ৪৩১ প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ

• নদী অবহেলিত, বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ
•  ভর্তুকি কিংবা পুনর্বাসন জরুরি 

ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বিপৎসীমায় ওঠানামা করছে। কোথাও বানের পানির উত্তাল ঢেউ, আবার কোথাও তীব্র স্রোত। হু হু করে বাড়তে থাকা পানিতে এখানকার নদ-নদীতীরবর্তী চর, চরদ্বীপসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ডুবেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি।

কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমরসমান পানিতে এখন বন্দি হাজারো মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। এদিকে যৌবনে ফেরা নদ-নদীগুলো জানান দিচ্ছে শক্তি-সামর্থ্যের। তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানির চাপ বিপৎসীমা ছাপিয়ে প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে ক্ষতির তালিকা।

উত্তরে সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও গঙ্গাধর নদ-নদী। গেল কয়েক দিনে ভারতের উজান থেকে ভাটির দিকে ধেয়ে আসা পানির ঢলে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে এসব নদ-নদী। জীবন-জীবিকার সব উৎস বন্ধ হয়ে গেছে বানের পানিতে। কোথাও কোথাও বাড়ির উঠোন কিংবা ঘরে পানি না উঠলেও রাস্তাঘাট তলিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। তাতে অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে জীবনযাত্রা।

দুদিন ধরে রংপুর অঞ্চলের নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর-নিচ প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ঘরবাড়িতে পানি থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে চর ও নিম্নাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষ। কিছু পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিলেও অনেক পরিবার এখনো বসবাস করছে নৌকায় ও ঘরে উঁচু করা মাচানে।

উত্তরে এখন বন্যায় সবথেকে বেশি আক্রান্ত কুড়িগ্রাম। জেলার চিলমারী, উলিপুর, রৌমারী, নাগেশ্বরীতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে মানুষ হাহাকার করছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল।

এদিকে নদীতীরবর্তী এলাকার গবাদি পশুপাখি পালনকারী খামারি, মাছচাষি ও কৃষকরাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের মাথায় বাজ পড়েছে। প্রতিবছর প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা নদীপাড়ের মানুষগুলো বানের পানিতে ভাসতে ভাসতে হিসাব কষছে ক্ষয়ক্ষতির। তবে চলমান বন্যা দীর্ঘায়িত হলে তাদের জন্য ভর্তুকি বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না গেলে এই অঞ্চলে মহাবিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত রংপুর বিভাগের চার জেলায় প্লাবিত হয়েছে ১ হাজার ৪২টি ছোট-বড় খামার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৮০৫ জন খামারি। চলতি বন্যায় শুধু মৎস্য খাতেই এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুই কোটি টাকা। বন্যা দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে।

মৎস্য বিভাগ রংপুরের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম জানান, বন্যায় কুড়িগ্রাম জেলায় ৬৭২টি খামারে ৫০ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, রংপুরে ১৪০টি মৎস্য খামারে ৩৫ লাখ টাকা, গাইবান্ধায় ২৫টি খামারে ২২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এবং লালমনিরহাট জেলায় ২০৫টি মৎস্য খামারে ক্ষতি হয়েছে ৮২ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

তিনি আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের তালিকা তৈরির পাশাপাশি ক্ষতি কমাতে নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যাতে খামারিরা তাদের পুকুর, দিঘি, বিলের চারপাশে জাল (নেট) দিয়ে ঘিরে রাখা বা বেড়া তৈরি করেন। এটা করা হলে বন্যায় পানি বাড়লে মাছগুলোর বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কা কম থাকবে।

অন্যদিকে রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর বলছে, এখন পর্যন্ত বিভাগের পাঁচ জেলায় বন্যার কবলে রয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি। তবে এরই মধ্যে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপদ জায়গায় গবাদি সরিয়ে নিতেও প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

এ ছাড়া বন্যায় এখন পর্যন্ত পানিতে ডুবেছে ১৫ হাজার ৩২০ হেক্টর আবাদি জমি। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত গাইবান্ধায় ১৩ হাজার ২৪ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১৩ হাজার ৭১১ হেক্টর এবং লালমনিরহাটে ২৮৫ হেক্টর আবাদি জমি এখন জলাশয়।

কৃষি অধিদপ্তর বলছে, পানি নেমে গেলে কত টাকার ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণ করা যাবে। তবে এই মুহূর্তে মাঠে ফসল না থাকায় কৃষিতে তেমন ক্ষতির প্রভাব পড়বে না।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাহবুবর রহমান জানান, আগাম বন্যা হয়ে গেলে আমাদের রোপা আমন ধানের ক্ষতিটা বেশি হয়। তবে এখন পর্যন্ত রোপা আমন ধান লাগানো বা রোপণ করা শুরু হয়নি। এ কারণে এই বন্যার পানি নেমে গেলে এটা আমাদের কৃষিতে একটা আশীর্বাদ হবে।

বানের পানি শিক্ষাঙ্গনেও হানা দিয়েছে। কোথাও হাঁটু, কোথাও আবার কোমরসমান পানিবন্দি প্রাথমিকের বিদ্যাপীঠ। বন্যার কারণে বিভাগের পাঁচ জেলায় ৪৩১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যালয় থেকে পানি নেমে গেছে।

রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উপপরিচালক মুজাহিদুল ইসলাম জানান, এখন (বুধবার) পর্যন্ত সবথেকে কুড়িগ্রামে বেশি বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই জেলায় ২৯৪ ছাড়াও গাইবান্ধা জেলার ১১১, লালমনিরহাটে ১৪, নীলফামারীতে ৫ এবং রংপুরে মাত্র একটি বিদ্যালয় শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে গবেষকরা বলছেন, বন্যায় উত্তরের সবথেকে বেশি ক্ষতি হয় বসতভিটার। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়াবে এক হাজার কোটি টাকা। যুগের পর যুগ নদীগুলো অবহেলিত থাকার ফলে প্রতিবছর এমন ক্ষতির শিকার তারা। একই সঙ্গে বাস্তুহারা হচ্ছে নদীতীরবর্তী শত শত পরিবার।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যদি এক লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, সেখানে ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে নদ-নদীর সুরক্ষা হয়, তখন সরকার তো সব কাজ ফেলে জাতীয় স্বার্থে শুধু নদীর কাজেই নিবেদিত হবে। এ জন্য সরকারের উচিত অন্তত একবার হলেও গবেষণা করে দেখা। উত্তরাঞ্চলে বছরে কয়েকবার করে ভয়াবহ বন্যা দেখা যায়। এর অর্থ এই নয় যে সিলেটে দুর্গতদের জন্য আমাদের দুর্ভাবনা নেই।

তিনি আরও বলেন, কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধার জন্য প্রকৃতি নিয়তি। রাষ্ট্র এখানে নিয়তি হয়ে উঠতে পারেনি। হাজার বছরের কিংবা তারও কম-বেশি দিন ধরে চলে আসা বৈষম্য-অবহেলা আজও বিদ্যমান। অঞ্চলপ্রেমিকদের দেখছি বন্যা নিয়ে সিলেটের সঙ্গে নিজ অঞ্চলের তুলনা করছেন। অঞ্চলভিত্তিক সমতা বিধানের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত লাগে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই পথ দেখিয়েছেন।

নদীগুলো রক্ষায় টেকসই পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রতিবছর যেমন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে, তেমনি নদীপাড়ের মানুষের প্রতি বাড়ছে সামাজিক অবমূল্যায়নও। যার প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়ও। দফায় দফায় বন্যায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চলের হিডেন ডায়মন্ডখ্যাত কৃষি। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভর্তুকি বা পুনর্বাসন করা না গেলে এই অঞ্চলে মহাবিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যর্থতা ও সরকার ঘোষিত তিস্তা নিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কালক্ষেপণ এ অঞ্চলের প্রতিবছর ক্ষয়ক্ষতি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহের বন্যায় নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি খেতসহ অনেকের বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে।

বন্যায় হাজার হাজার মানুষ এখন ঘরহারা, ভিটাহারা, উদ্বাস্তু। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভর্তুকি কিংবা পুনর্বাসনের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। না হলে কৃষিনির্ভর তিস্তাতীরবর্তী এলাকাগুলোয় মহাবিপর্যয় দেখা দেবে বলে মনে করেন তিনি।

এনএ