উজানের ঢল আর ভারী বর্ষণে তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরীসহ রংপুরের ছোট-বড় নদ-নদীগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময়জুড়েই পানিশূন্য থাকা এসব নদ-নদী এখন স্রোতের শক্তি-সামর্থ্য জানান দিচ্ছে। গেল কয়েক দিনে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, কিন্তু ভাঙন থামেনি নদীর।

বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই জলের ঢলে গতিমতি বদলে তিস্তা ও ঘাঘট হয়ে উঠছে রাক্ষসে। প্রতিদিন ভাঙনখেলায় নদীর পেট বড় হচ্ছে। এতে বাড়ছে বানভাসিদের আহাজারি। তিস্তার সঙ্গে এবার ভাঙন দেখা দিয়েছে ঘাঘট নদেও।

অব্যাহত ভাঙনে হুমকির মুখে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বড়বিল ইউনিয়নের পাকুড়িয়া শরিফ পুরাতন আদর্শ গুচ্ছগ্রামটি। সেখানকার শ্বশানের একটি মন্দির ইতোমধ্যে ঘাঘট নদে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছে।

কখনো তীব্র স্রোত আর আছড়ে পড়া ঢেউয়ে পাড়ের মাটি খসে গ্রাস করছে এলাকা। কয়েক দিন ধরে আদর্শ গুচ্ছগ্রামঘেঁষা ঘাঘট অশান্ত হয়ে উঠেছে। বন্যার পানি কমতে থাকায় ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন যেমন চোখে পড়ছে, তেমনি ভাঙনভীতিতে দিন কাটছে গ্রামবাসীর।

সরেজমিনে শুক্রবার (২৪ জুন) সকালে দেখা গেছে, ঘাঘটগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মরদেহ সৎকারে গ্রামের একমাত্র শ্বশানটি। মন্দির বিলীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বশানের বেশির ভাগ অংশ চলে গেছে ঘাঘটপেটে। এখন শ্বশানের চিহ্ন হিসেবে আছে দুটি মরদেহের স্মৃতি। সেটিও রয়েছে হুমকিতে। একই সঙ্গে ভাঙনঝুঁকিতে আছে শ্বশানঘেঁষা রাস্তা ও পুকুরসহ আবাদি জমি ও বেশ কিছু বসতভিটাও।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিবছর বন্যায় ভাঙন সৃষ্টি হলেও স্থায়ী ও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড। এভাবে প্রতিবছর একটি-দুটি করে গুচ্ছগ্রামের ২৪টি পরিবার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে এখন উদ্বাস্তু। এখন যারা আদর্শ গুচ্ছগ্রামে আছে, তারাও ঘাঘটের ছোবলের কাছাকাছি। এভাবে ভাঙতে থাকলে আশ্রয়হীন ও সর্বস্বান্ত হবে অনেক পরিবার।

বড়বিল ইউনিয়নের পাকুড়িয়া শরিফ পুরাতন গুচ্ছগ্রামটি গড়ে উঠেছে এরশাদ সরকারের সময়ে। প্রায় ৩৬ বছর আগের এই গুচ্ছগ্রামে শুরুতে মাত্র ৬০টি পরিবার ছিল। এখন পরিবার ও ঘরের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বাড়েনি গ্রামের পরিধি। কারণ প্রতিবছর ঘাঘট নদে খেয়ে নিয়েছে বসতি।

বয়সে লেটার মার্কস পাওয়া আব্দুল হামিদ বলেন, আগে ৬০টি ঘর ছিল। কিন্তু ভাঙতে ভাঙতে গুচ্ছগ্রামের ২৪টি ঘর ঘাঘট নদে চলে গেছে। এবারও ভাঙন শুরু হওয়ায় আমরা আতঙ্কিত। অনেকের বাঁশঝাড়, গাছগাছালি পানিতে ভেসে গেছে।

এই বৃদ্ধের ভাষ্যমতে, ঘাঘট নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গুচ্ছগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে দিন দিন ভাঙন তীব্র হচ্ছে। এতে সেখানকার মানুষজন আতঙ্কে আছেন। অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছে।

একই গ্রামের কৃষক আবদুল কাদের। তার বাড়ির মুখে চলে এসেছে ঘাঘট। মাটি ধসে বাঁশঝাড় ভেঙেছে পানিতে। ভাঙতে ভাঙতে আর কয়েক হাত এগিয়ে গেলেই খড়ের ঘরে হানা দেবে ঘাঘট। তাই তিনি নিজের বসতভিটা বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।

ঢাকা পোস্টকে ৬৫ বছর বয়সী আবদুল কাদের বলেন, নদী ছিল অনেক দূরে, ভাঙতে ভাঙতে এখন আমার ঘরের কাছে এসেছে। বারবার যদি ঘরবাড়ি ভাঙে তাহলে বাঁচব কী করে? ইউএনও, চেয়ারম্যান, মেম্বার সবাইকে এই গ্রামটি রক্ষায় অনেকবার আমরা বলেছি। কেউ আমাদের কথা শোনে না। নদী ভাঙলে আমরা নিঃস্ব হই, আর টাকাওয়ালা সেই জমিতে আবাদ করার সুযোগে থাকে। আমাদের কথা কেউ ভাবে না।

প্রতিবছর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নদীপাড়ে এমন বন্যা আর ভাঙন হয় জানিয়ে গুচ্ছগ্রামের যুবক মিরান মিয়া বলেন, আমাদের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় না। আমরা কষ্টে থাকি। প্রতিবছর ভাঙনের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ইউএনওকে বলে ভাঙন ঠেকাতে যদি কিছু বস্তার ব্যবস্থা হয়, সেটাও আমরা ঠিকমতো পাই না। আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে অর্ধেক কমে যায়। আমাদের গ্রামটি রক্ষা করতে যেন এখানে স্থায়ী বাঁধের সঙ্গে ও টেকসই ব্লকের ব্যবস্থা সরকার করে দেন। আমরা নিরাপদে এখানে থাকতে চাই।

ফসলি জমি আর জীবন-জীবিকার উৎস হারিয়ে অনেকে অন্যের জমিতে নয়তো আত্মীয়স্বজনের আশ্রয়ে আছে। কয়েক দিন আগে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার প্রভাব পড়ে ঘাঘটপাড়ে। সেই কথাই বলছিলেন বুলবুলি বেগম। ঢাকা পোস্টকে এই নারী বলেন, আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। বাচ্চাদের নিয়ে আমরা অনেক কষ্টে আছি। ঠিক মতো খাইতেও পারছি না। এখন ঘাঘট থেকে একটু দূরে ঘরের চাল ও আসবাব নিয়ে রেখেছি। এভাবে কি বাঁচা যায়?

একই এলাকার দিনমজুর কবির উদ্দিন বলেন, নদীর ওপরে আমাদের বাড়ি। আমরা প্রতিবছর ক্ষতির মধ্যেই থাকি। কখনো কখনো এক বন্যা মৌসুমে দুই-তিনবার বাড়িঘর ভেঙে সরিয়ে নিতে হয়। ঘাঘট তীব্র স্রোতের নদ। বর্ষা মৌসুম এলে আমরা সব সময় আতঙ্কে এবং ভাঙনের ভয়ে থাকি। এ জন্য আমাদের দাবি, সরকারি উদ্যোগে এই গ্রামের বাঁধটি রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

কৃষক মোনাব্বর হোসেন, সোহরাব মিয়াসহ আরও বেশ কয়েকজন জানান, পানি কমে গেলেও বিভিন্ন ফসলের খেতগুলো এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। কিছু খেত থেকে পানি সরে গেলেও এসব খেতে ফসল আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। বিশেষ করে বন্যায় তাদের বীজতলা, ভুট্টা খেত ও শাকসবজিসহ অন্যান্য আবাদ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। পানি সরে যাওয়ার পর ফসলে পচন দেখা দিতে পারে। তবে আবার পানি বাড়লে এর ঘাঘটপাড়ের গুচ্ছগ্রামসহ নদী তীরবর্তী পরিবারগুলোর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে বলে তারা দাবি করেন।

স্থানীয় পাকুড়িয়া শরিফ ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুল আলম জানান, আদর্শ গুচ্ছগ্রামঘেঁষা বাঁধটি এর আগে একবার ভেঙে গিয়েছিল। তখন রাস্তা ভেঙে যাওয়ার উপক্রমও হয়েছিল। পরে সরকার বাঁধ দিয়ে রাস্তাটি রক্ষা করে। কিন্তু আবার নদীভাঙনের কারণে শ্বশানঘাটটি বিলীনের পথে। সঙ্গে বাঁধটিও ভেঙে যাচ্ছে। যদি ভাঙন অব্যাহত থাকে, তাহলে রাস্তাঘাট, দিঘী ও গুচ্ছগ্রামটি ঘাঘটের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। আর এমনটা হলে অনেক পরিবার ভূমিহীন ও নিঃস্ব হয়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।  

এদিকে ভাঙনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বড়বিল ইউনিয়ন পরিষদ ৪ নং ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) বুলবুল আহমেদ। এ সময় ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে অবগত করেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে বড়বিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শহীদ চৌধুরী দ্বীপকে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও চেয়ারম্যান কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি। 

গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদ উদ্দীন জানান, তিস্তা ও ঘাঘটের ভাঙনকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অবগত করেছেন। তারা ভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া অব্যাহত রয়েছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ