চিকিৎসকদের খুশি করতেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ঢুকছেন ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা (এমপিও)। খুশি হয়ে চিকিৎসকরা রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে পছন্দের কোম্পানির ওষুধও লিখছেন। রোগীদের ধরে ধরে ব্যবস্থাপত্রের ছবি তুলে সেটি আবার যাচাইও করছেন এমপিওরা। 

গত রোববার (২৬ জুন) হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে রোগীদের পথ আগলে ছবি তুলছিলেন এমপিওরা। এ নিয়ে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে তাদের বাদানুবাদ হয়। পরে তিন এমপিওকে কোমরে দড়ি বেঁধে আটকে রাখেন আনসার সদস্যরা। ওই দিন মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু সহকর্মীদের সঙ্গে আনসার সদস্যদের এমন আচরণে ক্ষুদ্ধ সারা দেশের ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা। সোমবার (২৭ জুন) থেকেই রাজশাহীসহ সারা দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে।

বুধবার (২৯ জুন) দুপুরের দিকে তাদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত রাখার ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ফার্মাসিউটিক্যালস এক্সিকিউটিভ ফোরামের রাজশাহী শাখার সভাপতি মোশাররফ হোসেন। তিনি জানান, হাসপাতাল পরিচালক অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি হাসপাতালে প্রবেশে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের বিধি-নিষেধ মানার আহ্বান জানিয়েছেন।  

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস রিপ্রেজেন্টেভস অ্যাসোসিয়েশনের (ফারিয়া) সভাপতি শফিক রহমান জানিয়েছেন, রামেক হাসপাতালের এই ঘটনা আমাদের চরমভাবে মর্মাহত করেছে। সারা দেশে এই ঘটনার প্রতিবাদ হয়েছে। আমরা চাইনি ওষুধেরমতো জরুরি পরিষেবা বন্ধ করতে। আমরা হাসপাতাল পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করেছি। পরিচালক নিয়ম মেনে সোমবার ও বুধবার বেলা ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত পরিদর্শনের কথা জানিয়েছেন। 

এরপরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পরিচালক। আমরা নিয়ম মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। বৈঠকের পর আমরা আমাদের কর্মসূচি স্থগিত করেছি।

কোম্পানির প্রতিনিধিরা চিকিৎসকদের খুশি করতে হাসপাতালে যান কি না জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেন, আমাদের ৭০ শতাংশ কাজ তথ্যভিত্তিক। আমরা চিকিৎসকদের সঙ্গে সাক্ষাত করি কেবল নতুন নতুন তথ্য পৌঁছে দিতে। ওষুধের প্রচারণাও সেই সঙ্গে হয়। চিকিৎসকদের নিয়ে সভা-সেমিনার এমনকি বিদেশ ভ্রমণের আয়োজন হয়। এটি কেবল চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতেই। মানুষ যেটা ভাবেন আসলে চিকিৎসকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ঠিক ওইটা না।

নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন এমপিও জানান, চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কাছে কতো করে কমিশন পান, কতো ফ্রি ওষুধ নেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবই জানে। চিকিৎসকের চেম্বারে ফ্যান কিংবা এসি দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানি। ওষুধ কোম্পানির দেওয়া চেয়ার-সোফায় বসছেন চিকিৎসকরা। তারা যে টিস্যু ব্যবহার করেন সেগুলো দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানি। চিকিৎসকদের বাসা-বাড়িতে টেলিভিশন-ফ্রিজসহ নানা আসবাবপত্র যাচ্ছে ওষুধ কোম্পানির টাকায়। তাদের অবকাশ ভ্রমণের বন্দোবস্তও করছে ওষুধ কোম্পানিগুলো।

তবে কেউ কেউ বলছেন, সব চিকিৎসকই উপহার নেন, এটা বলার সুযোগ নেই। আবার সব এমপিও এই কাজ করেন-সেটিও বলা যাবে না। তবে যা ঘটে সেটি ‘ওপেন সিক্রেট’। ফলে চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই। বিরোধ কেবল হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গেই।

নাম প্রকাশ না করে একজন কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, কিছু এমপিওর নির্ধারিত বেতন নেই। তারা কমিশনে কাজ করেন। এরাই মূলত রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি নেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি নেন তারা। এ ছাড়া হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়া রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি নেন। মূলত নিজেদের ওষুধ চিকিৎসকরা লিখেছেন কি না সেটিই পরখ করতে এই কাজ তারা করেন। কোম্পানিগুলো প্রচুর চাপ দেয়।

তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক তিন সহকর্মীর কোমরে দড়ি বাঁধায় ক্ষুদ্ধ এমপিওরা। তারা বলছেন, এই পেশায় যারা এসেছেন, তারা নূন্যতম স্নাতক ডিগ্রিধারী। এমপিওদের সঙ্গে চিকিৎসদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা কেবল নিরাপত্তা কর্মীদেরই।

এমপিওদের প্রতি এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত। রশি দিয়ে বাঁধা ঠিক হয়নি বলে জানান রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী। তিনি বলেন, কোনোভাবেই হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের আটকানো যাচ্ছে না। চিকিৎসকরা হাসপাতালে নির্দিষ্ট একটা সময় চিকিৎসাসেবা দেন। ওই সময়টুকু কেবলই রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকার কথা। কিন্তু ওই সময়ের ভেতরই অনেক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি চিকিৎসকদের সামনে বসে থাকেন। এতে রোগীরা বঞ্চিত হন।

আবার কিছু চিকিৎসক তাদের কাছে থেকে নানান সুবিধা পান। এর বিনিময়ে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাদের ওষুধ লিখতে চাপ দেন। কেউ কেউ সরকারি ওষুধের সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ওই কোম্পানির ওষুধ লিখেন। দামি এসব ওষুধ কিনতে গরিব রোগীদের কষ্ট হয়।

আবার কোম্পানির প্রতিনিধিরা হাসপাতালে এসে দেখেন চিকিৎসক কোন ওষুধ লিখছেন। তারা রোগীকে আটকে ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলেন। এটি একেবারেই অনৈতিক। হাসপাতালে এই কাজ কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যায় না।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরআই