অভিযুক্ত জাহিদুল ইসলাম জুয়েল

লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ভোলাকোট গ্রামে ৩৫ কৃষকের ফসলি জমি জোর করে দখল করে মাটি কেটে বিক্রি করছেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক বহিষ্কৃত সদস্য জাহিদুল ইসলাম জুয়েল। প্রায় ৪০ একর জমিতে পুকুর কেটে তিনি মাছ চাষের খামার করেছেন।

এর প্রতিবাদ করায় মারধরসহ হয়রানির শিকার হচ্ছেন জমির মালিকরা। তারা জুয়েল ও তার অনুসারীদের হামলা-হয়রানির আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের কয়েকজন ভয়ে এলাকাছাড়া হলেও এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হন না।

বিষয়টি নিয়ে জুয়েলের বিরুদ্ধে জেলা আদালতে মামলা ও জেলা প্রশাসকসহ সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার (২৫ জুন) বিকেলে জমি দখলের মামলা তদন্তে ঘটনাস্থলে আসেন নোয়াখালী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক (তদন্ত) সৈয়দ মোহাম্মদ নুর। তিনি ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে জুয়েলকে উপস্থিত থাকতে বলা হলেও তিনি হাজির হননি।

জাহিদুল ইসলাম জুয়েল উপজেলার ভোলাকোট ইউনিয়নের ভোলাকোট গ্রামের পূর্ব ভূঁইয়া বাড়ির সৈয়দ আহমদের ছেলে।

ভুক্তভোগী জমির মালিকরা হলেন ভোলাকোট গ্রামের আবদুল আজিজ, মাওলানা গোলাম রসুল, শাকিল মাহমুদ, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, আবদুল কাদের, কবির হোসেন, আরিফ হোসেন, জসিম উদ্দিন, ফরিদ হোসেন, জাহিদ হাসান, নলচারা গ্রামের রুহুল আমিন, লক্ষ্মীধরপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, পাচরুখি গ্রামের মো. নয়নসহ ৩৫ জন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়ির পাশে জুয়েল তাদের প্রায় ৪০ একর ফসলি জমিতে জোর করে মাছের খামার করেছেন। চারপাশে উঁচু করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য রাত-দিন শ্রমিক দিয়ে কয়েকটি খননযন্ত্রের মাধ্যমে মাটি কাটছেন। মাটিগুলো পাহাড় ট্রলি-ছোট পিকআপ ভ্যানযোগে স্থানীয় ইটভাটায় সরবরাহ করছেন। তবে রাতে বিরামহীন কাজ চলে।

স্থানীয় গ্রামবাসী ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ তিনজন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুয়েলের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে লোকজনকে মারধর ও গুলি করার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় অন্তত পাঁচবার তিনি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে ফের অপকর্মে জড়ান। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছিলেন। সে সময় তার কর্মকাণ্ডে স্থানীয় প্রশাসনের ঘুম অনেকটাই হারাম ছিল।

তারা আরও জানান, জুয়েল সন্ত্রাসীদের পাহারা বসিয়ে মাটি কাটার কাজ করে। এসব জমিতে অর্ধকোটি টাকার ধান উৎপাদন হতো। জমি দখলের প্রতিবাদ করতে গেলে জমি মালিকদের শারিরীকভাবে লাঞ্চিত ও ‘জামায়াত-শিবির’ আখ্যা দিয়ে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়। তবে বৃষ্টির কারণে গত ১০ দিন কাজ বন্ধ রয়েছে।

ভুক্তভোগী সৈয়দ আহম্মদ রেদোয়ান বলেন, জুয়েল শ্রমিক নিয়ে আমাদের জমির মাটি কেটে বিক্রি শুরু করে। আমি এর প্রতিবাদ করতে গেলে সে আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। বলে, না দিলে জমিটি আমার ভোগদখলে থাকবে না। আমার জমির মাটিও কাটছে, আবার চাঁদাও চায়। পরে সে আমাকে মারধর করে এবং অপহরণ করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এ ঘটনায় আমরা আদালতে মামলা করেছি।

আরেক ভুক্তভোগী আরিফ হোসেন বলেন, আমার ৪৪ শতাংশ ফসলি জমিতে জুয়েল জোর করে পুকুরে কাটায় আদালতের দারস্থ হয়েছি। আদালত ওই জমিতে স্থিতবস্থার নির্দেশ দেন। কিন্তু তা কর্ণপাত না করে ও প্রশাসনকে পাত্তা না দিয়ে সে মাটি কাটছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক জানান, জুয়েলের একটি বাহিনী রয়েছে। তার অন্তত ২০ থেকে ৩০ জন সহযোগী রয়েছে। তারা এলাকায় নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। তাদের ভয়ে সবাই চুপ করে থাকে। মানসম্মানের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না।

অভিযোগ বিষয়ে জাহিদুল ইসলাম জুয়েল বলেন, আমি কারও জমি জোর করে দখল করিনি। কয়েকজন মালিকের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছি। খামারের এক-তৃতীয়াংশ জমি আমার। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছয়বার এসে তদন্ত করেছেন।

তিনি দাবি করেন, তার কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী নেই। কোথায়ও লাশ, ডাকাতি, মাদক পেলে তাকে সবাই মামলার আসামি করা হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাই তার বিরুদ্ধে এসব মামলা ও অভিযোগ তুলছে।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনিরা খাতুন বলেন, জমির মালিকদের অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় তহশিলদারকে সরেজমিনে পাঠিয়ে তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন দাখিলের পর শুনানির তারিখ জানানো হয়। কিন্তু অভিযুক্ত জুয়েল শুনানিতে হাজির হননি। এ বিষয়ে আমি ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে দিয়েছি।

রামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমদাদুল হক বলেন, এলাকাবাসী জানান জুয়েল খারাপ প্রকৃতির লোক। তার কর্মকাণ্ড সামাজিক না। তার বিরুদ্ধে থানায় এখন তিনটি মামলার কাগজপত্র পেয়েছি। জমির মালিকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত আমি তিন মাসে অন্তত ২০ বার মাটি কাটা বন্ধ করেছি। রাতে সে কাজ করে। ভুক্তভোগীদের মামলা করার জন্য পরামর্শ দিয়েছি।

নোয়াখালী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক (তদন্ত) সৈয়দ মোহাম্মদ নুর বলেন, আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। অভিযুক্তকে তদন্তকালে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছিল, তিনি থাকেননি। মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, ভূমিদস্যুতার বিষয়ে আমরা সম সময় সোচ্চার রয়েছি। জুয়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে তদন্তের জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

এনএ