কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পাগলা মসজিদে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে। যার নামকরণ হবে ‘পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স’। এটি নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। সেখানে ৬০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন। 

পাগলা মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, প্রতি জুমার দিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে এ পাগলা মসজিদে আসেন। এছাড়াও এই দিন মাসজিদে দান ও মানত করতে আসেন অনেকেই। মুসল্লিরা বাহিরে রোদে বা বৃষ্টিতে ভিজে নামাজ আদায় করেন। তাই মসজিদ কমিটি আধুনিক ইসলামিক কমপ্লেক্স করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে একসঙ্গে ৬০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদের ভেতরে ৩১ হাজার এবং বাহিরে ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদের আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকবে ৩০০ গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। মসজিদের পাশেই নির্মিত হবে একটি পুরুষ এবং একটি মহিলা মাদ্রাসা। থাকবে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এছাড়াও একটি বিশ্রামাগার থাকবে যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষজন বিশ্রাম নেবে। এর জন্য গত সপ্তাহে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় টেন্ডার চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও করা হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শামীম আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় বছর ধরে পাগলা মসজিদের দানের মূল টাকা খরচ করছি না। এগুলো ব্যাংকে জমা রাখা হচ্ছে। যা দিয়ে এখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত দৃষ্টিনন্দন ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। ওই কমপ্লেক্সে ৬০ হাজার মুসল্লির একসঙ্গে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা থাকবে। নারীদের জন্য পৃথক নামাজের ব্যবস্থাও থাকবে সেখানে। সঙ্গে দুটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হবে। থাকবে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ আরও নানা আয়োজন। এ প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। টেন্ডারের মাধ্যমে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। এতে প্রকৃতপক্ষে কত খরচ হবে তারা তা চূড়ান্ত করে আমাদের জানাবেন। এরপর কাজ শুরু হবে কমপ্লেক্সের। এটি যেন ইসলামি স্থাপত্যের আনন্য একটি উদাহরণ হয়, সেইভাবেই নির্মাণ করা হবে।

তিনি আরও জানান, ইসলামিক কমপ্লেক্সের পুরো ব্যয় দানের টাকা থেকে করা হবে। তবে এর পরও যদি আরও টাকা লাগে তখন দেখা যাবে।

জনশ্রুতি রয়েছে, কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া ও রাখুয়াইল এলাকার মাঝপথে প্রবাহিত নরসুন্দা নদের মধ্যবর্তী স্থানে জেগে উঠা উঁচু টিলাকৃতির স্থানটিতে এক সময় এক আধ্যাত্মিক পাগল সাধকের বাস ছিল। মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে সব ধর্মের লোকজনের যাতায়াত ছিল ওই সাধকের আস্তানায়। ওই পাগল সাধকের মৃত্যুর পর তার উপাসনালয়টিকে কামেল পাগল পীরের মসজিদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করে এলাকাবাসী।

পরে আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে এলাকার লোকজন ও দেশের দূর-দূরান্তের লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন। তারা নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন। বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ঢল নামে। আগতদের মধ্যে মুসলিমদের অধিকাংশই জুমার নামাজ আদায় করেন এ মসজিদে। এই ইতিহাস প্রায় আড়াইশ বছরেরও অধিক সময়ের বলে জানা গেছে।

বর্তমানে কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পাগলা মসজিদ অন্যতম। শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ জমির ওপর মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। মসজিদটির পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্য। মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে মূল মসজিদ ভবনও।

ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত মসজিদটিকে পাগলা মসজিদ ইসলামি কমপ্লেক্স নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদটিকে একটি আন্তর্জাতিক ইসলামিক কমপ্লেক্সে করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মসজিদের আয় থেকে বিভিন্ন সেবামূলক খাতে অর্থ ব্যয় করা হয়।

মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্স ও মাদ্রাসার সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন ১ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, একজন খতিব, একজন পেশ ইমাম, তিনজন মুয়াজিন, সাতজন শিক্ষক, একজন অফিস সহকারী, একজন সিসিটিভি ও কম্পিউটার অপারেটর, দুইজন বাবুর্চি, আট পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ১০ জন আনসার ও নিজস্ব ১৩ জন নিরাপত্তাকর্মী। বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন এ কমপ্লেক্সটিতে।

পাগলা সমজিদের নিরাপত্তার জন্য মসজিদটি ৬০টি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ ছাড়া ১০ সদস্যের সশস্ত্র আনসার টিম সর্বদা নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। মসজিদটির সার্বিক তদারকির জন্য ৩৪ সদস্যের একটি দল কাজ করে।

দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু তদারকির জন্য কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষে জেলা প্রশাসককে সভাপতি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদককে সহসভাপতি এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি), সদর মডেল থানার ওসি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ কমিটি গঠিত। এ ছাড়াও সুশীল সমাজের পক্ষে একজন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

এসকে রাসেল/আরএআর