স্বামীর একার আয়ে সংসার চলে না অপর্ণা হালদারের। তাই চার বছরের ছেলেকে নিয়ে সাপ্তাহিক হাটে এসেছেন তিনি। সঙ্গে এনেছেন মাছ ধরার ১৮টি গড়া। সেগুলো বিক্রি করে যা রোজগার হবে সেই টাকায় সপ্তাহ পার করবেন তিনি।

অপর্ণা হালদার জানান, নিজেই বাঁশ কিনে এনে তা কেটে কঞ্চি বের করেন। সংসারের অন্য কাজের পাশাপাশি সময় পেলেই কঞ্চি দিয়ে তৈরি করেন গড়া। সেগুলো হাটে তুলে বিক্রি করেন নিজেই।

তিনি জানান, ‘আটঘর বাজার’ না হলে হয়তো এই আয় করতে পারতেন না। তখন অন্য কাজে যুক্ত হতে হতো। এজন্য আটঘর বাজার তার সংসারের আশীর্বাদ। এক সপ্তাহে ১৮ পিস গড়া বুনতে পেরেছেন তিনি। ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে সেগুলো বিক্রি করে যা রোজগার হবে সেই টাকায় সপ্তাহ পার করবেন।

শুধু অপর্ণা হালদার নয়, তার মতো কয়েক শ পরিবার রয়েছে যারা আটঘর বাজারের ওপর নির্ভরশীল। লোকমুখে আটঘর বাজার বললেও মূলত এটি সাপ্তাহিক হাট। প্রতি শুক্রবার জমে মাছ ধরার উপকরণ বিক্রির এই হাট। এমনকি সারা বছরে বর্ষা মৌসুমকে কেন্দ্র করে মোট পাঁচ মাস জমজমাট থাকে। এজন্য বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার ৮টি উপজেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের রোজগারের মাধ্যমও বলা চলে আটঘর হাটকে।

আটঘর হাটের অবস্থান পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন খালের পাড়ে। বিক্রেতাদের দাবি, বিখ্যাত এই হাটে ক্রেতা বা দর্শনার্থীদের বসার কোনো স্থান নেই। এমনকি উপজেলা প্রশাসন থেকেও হাটের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

বিগত ৩০ বছর ধরে চাঁই-বুচনা-খলনি তৈরি করছেন স্বপন কুমার হালদার। তিনি জানান, শুধু আটঘর নয়, পাশাপাশি আরও কয়েকটি হাট জমতো কয়েক বছর আগেও। কিন্তু মেশিনে তৈরি সরঞ্জামের কারণে হাতে তৈরি চাঁই-বুচনা-খলনির সেই হাট এখন আর জমে না। তবে আটঘর এখনো টিকে আছে।

স্বপন কুমার হালদার বলেন, চাঁই ব্যবসা লাভজনক। বর্ষা মৌসুমে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ ধরার চাঁই, বুচনা, গড়া, খলনি, হাতে বোনা জালের ব্যাপক চাহিদা হয়। আমি চাঁই তৈরি করি। এগুলো বিভিন্ন মাঠে, খালে, নদীর কিনারে পেতে মাছ ধরা হয়। এই চাই ব্যবসা করেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চলছে।

আরেক ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী চাই ব্যবসা করছেন বিগত ২০ বছর ধরে। তিনি জানান, মৌসুমের ওপর নির্ভর করে চাঁই-গড়ার দরদাম ওঠানামা করে। গত হাটেও তিনি পাঁচ শ থেকে সাড়ে পাঁচ শ টাকায় এক জোড়া চাই বিক্রি করেছেন। কিন্তু এখন তিন শ থেকে চার শ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ ক্রেতা কমে গেছে। যেহেতু বর্ষার মাঝামাঝি সময় চলছে। এজন্য অনেক গৃহস্থ ইতোমধ্যে চাঁই-বুচনা-গড়া বা খলনি কিনে নিয়েছেন।
 
ইদ্রিস আলী জানান, এই হাটে ২২০ পিস চাই নিয়ে এসেছেন। এক সপ্তাহ ধরে এই চাঁই তৈরি করতে কমপক্ষে ১০ জন কারিগর একসঙ্গে কাজ করেছেন। বর্তমানে লোকসান না হলেও লাভ হচ্ছে না। তবে বর্ষার শুরুতে চাঁই বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন। আটঘরে পাঁচ মাস ব্যবসা করে বছরের বাকি সময় অন্য ব্যবসা করেন। তবে এই পাঁচ মাসের আয়েই সংসারের অর্থের জোগান দেয়।

সঞ্জয় মণ্ডল নামে আরেক কারিগর বলেন, বর্তমানে চাঁই-বুচনা-খলনি বেশি হাটে উঠেছে। কিন্তু সে অনুপাতে ক্রেতা নেই। এজন্য দাম কমিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে মৌসুমের শুরুতে বেশি দাম থাকে। তখনই মূলত আমাদের বাৎসরিক রোজগার হয়ে যায়।

রমেশ চন্দ্র হালদার বলেন, সংসারের অন্য আয়ের পাশাপাশি অবসর সময়ে এসব তৈরি করি। চাই-বুচনা-খলনি-গড়া বিক্রি করে সম্পূর্ণরূপে সংসার না চললেও বড় একটি আয় এখান থেকে আসে।

চাঁই কিনতে আসা ক্রেতা মোতালেব হাওলাদার বলেন, এই অঞ্চলের মধ্যে বিখ্যাত হাট আটঘর। কুড়িয়ানাও বিখ্যাত, তবে সেটি পেয়ারার জন্য। এই হাটে গ্রামীণ মানুষের হাতে বানানো সব কিছু পাওয়া যায়। তাজা সবজি, হাতে বানানো সরঞ্জাম। আমি মাঠে চাঁই পাতবো। গত হাটে ৫০টি কিনেছি। এখন আবার এসেছি যদি দরদামে মিলে যায়, তাহলে কিনে নিব। 

তিনি বলেন, এত সুন্দর একটি অর্থনৈতিক হাট অথচ বৃষ্টি এলে মানুষ এখানে কোথায় বসবে, তার কোনো ব্যবস্থা নেই।  

বাজারের ইজারাদার আব্দুর রহিম বলেন, আটঘর ঐতিহ্যবাহী একটি বাজার। এখানে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। যেমন সবচেয়ে বড় নৌকার হাট এটি। চাঁই-বুচনা, পেয়ারা, সবজির জন্যও বিখ্যাত বাজার। বলা চলে এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছে আটঘর বাজার।

নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোশারেফ হোসেন বলেন, আটঘর বাজারটি এই অঞ্চলের মধ্যে বিখ্যাত বাজার। এখানে মাছ ধরার উপকরণ বিক্রির যে হাট রয়েছে সেটি মূলত অস্থায়ী ব্যবসায়িক স্থান। মূল হাটের অংশ হলেও সপ্তাহে একবার ক্রেতা-বিক্রেতারা আসেন। এই অংশটি কেবলমাত্র বর্ষা মৌসুমে জমজমাট থাকে। ব্যবসায়ীরা যদি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হাটে শেড নির্মাণ করেন আবার হাট শেষ হলে অস্থায়ী সেই হাট নিয়ে যান। আমি মনে করি ব্যবসার ক্ষেত্রে ছাউনি আছে বা নেই এটি বড় কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। তবে ব্যবসায়ীদের হাট কেন্দ্রিক কোনো সমস্যা হলে সেটি আমি দেখব। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আবীর হাসান/আরএআর