দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রায়হান হাটবাজারে দোতারা বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়ান। এতে তার দিনে আয় হয় গড়ে ২০০ টাকা। এই টাকা দিয়েই চলে সংসারের খরচ ও চারজন মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে এবার ঈদে সন্তানদের একটি জামাও কিনে দিতে পারেননি বলে তার মনে বেজায় দুঃখ।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশের সদর ইউনিয়নের উলিপুর গ্রামের মৃত গঞ্জের আলী প্রামাণিকের ছেলে রায়হান আলী (৪২)। জন্মের দুই বছর পর দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। পরিবারে তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে আপনের বয়স ৪। মেয়ে রাশিদা (১০) স্থানীয় একটি মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।

ঈদুল আজহার পরের দিন (১১ জুলাই) বেলা আড়াইটা। তাড়াশ উপজেলার মান্নাননগর বাজারে সবুজ সাথী মেডিসিন কর্নারের সামনে কয়েকজন মানুষের ভিড়। সেখানে বসে দোতারা বাজিয়ে গান গাইছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রায়হান। তার চোখের কোনো ভাষা না থাকলেও মনের ভাষাগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মাঝে। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছেন তার লালনগীতি ও বাউলগান।

জটলার কাছে গেলে কথা হয় রায়হানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার দুই বছর বয়সে চোখ উঠেছিল। তারপর থেকে আমি অন্ধ হয়ে যাই বলে বাপ-মার মুখে শুনছি। এ কারণে অনাদরেই কাটতে থাকে জীবন। চোখে না দেখায় ৮ থেকে ১০ বছর আগে হাতে দোতারা তুলে নিই। তারপর থেকেই এভাবে হাটেবাজারে গান গেয়ে চলেছি।

রায়হান তাড়াশ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, কাছিকাটা, চাচকৈরসহ অনেক এলাকায় গিয়ে গিয়ে গান। যা আয় হয়, তা দিয়ে পরিবারের জন্য কিছু বাজারসদাই করে আনেন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের কোনো আবদার পূরণ করতে পারেন না বলেও তার মনে অনেক কষ্ট।

তিনি বলেন, উলিপুর হাটখোলার পাশের সরকারি জায়গায় একটি ঘর তুলে কোনোরকমে থাকি। মেম্বারকে বলেছিলাম একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু পাইনি। ঘরে দুটি ছেলে-মেয়ে। তাদের ভালো কিছু দিতে পারি না। তাদের জন্য ঈদের কোনো পোশাকও কিনতে পারিনি। স্ত্রীর কথা নাহয় বাদই দিলাম। গান গেয়ে যে টাকা পাই, তাই দিয়ে কোনো রকমে চলে যাই। সেই টাকা দিয়েই ঈদে কিছু বাজার করেছিলাম বাড়িতে খাওয়ার জন্য।

ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার বিষয়ে তিনি বলেন, ছেলেটি চার বছর বয়স। সে এখনো স্কুলে যায় না। তবে মেয়েটি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ক্লাস ফাইভে পড়ে। তার স্কুলের বই-খাতা-কলমগুলোও ঠিকমতো কিনে দিতে পারি না

সবুজ সাথী মেডিসিন কর্নারের স্বত্বাধিকারী পল্লিচিকিৎসক গোপাল চন্দ্র ঘোষ বলেন, রায়হানকে অনেক বছর ধরে চিনি। তার পরিবারের সবাইকে আমি বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে আসছি। সে আমার দোকানে এসে গান শোনায়। আমরাও মুগ্ধ হয়ে তার গান শুনি। সব সময় যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করি। তবে সরকার যদি তার ও পরিবারের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তার দুটি ছেলে-মেয়ে বড় হতে পারবে।

সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৪ নং ওয়ার্ডের সদস্য (কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্বরত) মো. আব্দুস সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়হান খুবই নিঃস্ব একজন মানুষ। আমরা সবাই মিলে তাকে একটি ছোট্ট ঘর তোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। যেহেতু এই এলাকা এখন ইউনিয়ন থেকে পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এখন তাড়াশ পৌরসভার অধীনে, তাই পৌরসভার দায়িত্বে আছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। আমি তার নামটি ইউএনও বরাবর জমা দিয়েছি।

সদর ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, রায়হানের বিষয়টি আমার জানা নেই। এ ছাড়া ওই এলাকা এখন পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। তবে আমি বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে তার জন্য কিছু করার চেষ্টা করব। তার ছেলে-মেয়ের জন্য নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করব।

তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেজবাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপাতত বন্যার কারণে গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। তবে আগামী সেপ্টেম্বরে আবার শুরু হবে। আমি তার খোঁজখবর নিয়ে অবশ্যই তাকে একটি সরকারি ঘরের ব্যবস্থা করে দেব।

এনএ