গত কয়েক বছরের মতো এবারও রংপুরে কোরবানির পশুর চামড়া ‘সস্তা দামে’ বেচা-কেনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সরকার নির্ধারিত ন্যায্য দাম পাননি সাধারণ মানুষ। মৌসুমী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা সামান্য লাভের মুখ দেখলেও কোরবানির চামড়ায় মোটা অংকটাই থাকছে বড় বড় ব্যবসায়ীদের পকেটে। প্রতিবছর এ রকম সিন্ডিকেটের ফাঁদে রংপুরে কমছে কোরবানির পশুর চামড়ার আমদানি। সঙ্গে বাড়ছে অবিক্রিত চামড়া মাটিচাপা দেওয়ার ঘটনা।

সচেতন মহল বলেছে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতে না পারলে গরিবরা তাদের হক বঞ্চিত হবেন। তেমনি কোরবানির পশুর চামড়া মাটিচাপা দেওয়া রীতিতে পরিণত হবে। সিন্ডিকেট বন্ধ করে চামড়া শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সঙ্গে চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও ঋণ সুবিধার আওতায় আনতে হবে।

এদিকে সাধারণ মানুষ এবং মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চামড়ার জন্য প্রসিদ্ধ রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর টার্মিনাল রোডের চামড়াপট্টি এলাকার ব্যবসায়ীরাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে এবারও সস্তায় চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। গরুর চামড়ায় দাম মিললেও ছাগলের চামড়া ফ্রি-তে দিতে হয়েছে। চামড়ার দাম কম দিতে নানা অযুহাতের ফাঁদগল্প শুনতে হয়েছে তাদের।

তবে চামড়া ব্যবসায়ীদের দাবি, সিন্ডিকেট মফস্বল পর্যায়ে হয়নি, এটি ঢাকায় হয়ে থাকে। মূলত পুঁজি সংকটসহ লবণের দাম বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে সরকার নির্ধারিত দামে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। 

ঈদুল আজহার প্রথম দিন বেলা ১টার পর থেকেই রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর টার্মিনাল রোডের হাজীপাড়ায় (চামড়াপট্টি) চামড়া কেনা-বেচা শুরু হয়। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কোরবানির পশুর চামড়া বেচতে এই এলাকায় আসেন। হাতেগোনা তিন-চারজন বড় ব্যবসায়ী ছাড়া বেশিরভাগ মৌসুমী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা কম মূল্যে চামড়া কিনেছেন। গরুর চামড়ার নামমাত্র মূল্য পেলেও অনেকেই ছাগল-ভেড়ার চামড়া ফ্রিতে দিতে বাধ্য হয়েছেন। আমদানি কম হওয়াতে প্রথমদিনে রাত ১২টা পর্যন্ত চামড়া কেনাবেচা করতে দেখা যায়।

ঈদের দিন সকাল থেকে পাড়া মহল্লায় ঘুরে ঘুরে পাঁচটি গরুর ও ছয়টি খাসির চামড়া কেনেন রনি মিয়া। নগরীর করণজাই রোড এলাকায় মৌসুমী এই ব্যবসায়ী জানান, এবার তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ৫টি গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা মূল্যে কিনেছেন। আর ছাগলের চামড়া নেন ৫-২০ টাকা করে। সন্ধ্যায় সেগুলো স্থানীয় চামড়াপট্টিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছেন। তবে ছাগলের চামড়ায় লোকসান হলেও পাঁচটি গরুর চামড়া বেচে তার সাড়ে ৪০০ টাকা লাভ হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে তিনি ন্যায্য দাম পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

একই রকম অভিযোগ সখের বশে চামড়া কেনা নুরুল হকের। এই মৌসুমী ব্যবসায়ী বলেন, মিডিয়ার লোকেরা যখন ক্যামেরা ধরছে তখন বড় বড় ব্যবসায়ী মিথ্যা কথা বলছে। আমাদের সামনে টিভিতে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকায় চামড়া কিনছে বলে প্রচার করছে। অথচ মিডিয়ার লোক চলে যাবার পর নানা ছুতোয় আড়তদাররা সস্তা দামে চামড়া কিনছেন। আমি ১ লাখ ৫ হাজার টাকার একটা কোরবানির গরুর চামড়া ৭০০ টাকায় কিনে এনে কেনা দামেই বিক্রি করেছি। ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে পারিনি। সেগুলো রাস্তায় ফড়িয়াদের ফ্রিতে দিয়ে এসেছি।

জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের মোবাইল ফোন মেকানিক আবু সায়েম লাভলু বলেন, প্রতিবছর সিন্ডিকেট হয়, এ জন্য আমরা চামড়ার দাম পাই না। এই চামড়ায় তো গরিবের হক রয়েছে। সিন্ডিকেট করে বড় বড় ব্যবসায়ী আর ট্যানারি মালিকরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গরীবেরা। ৭৮ হাজার টাকায় কেনা একটি গরুর চামড়ার দাম ২০০ টাকাও বলে না।

রংপুর সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন আব্দুল মজিদ। তিনিও ক্ষুদ্ধ চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে। দুটি খাসির চামড়া বিক্রি করতে গিয়ে হতাশার ছাপ ছিল তার চোখে মুখে। এই চাকরিজীবী বলেন, দুটি খাসির চামড়া ১০ টাকাতে বিক্রি করেছি। প্রথমে তো কেউ নিতে চায়নি। পরে অবশ্য একজন চা খেতে ১০ টাকা দিয়েছেন। অথচ রাতের বেলা একেকজন ব্যবসায়ীর গুদামে শত শত খাসির চামড়া লবণজাত করতে দেখলাম। সিন্ডিকেট না হলে কি এভাবে তারা চামড়া কিনতে পারত? সরকারের উচিত অসাদু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

সাধারণ মানুষ আর মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগের শেষ নেই। একেকজনের একেক রকম অভিযোগ হলেও সবাই শঙ্কিত চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ রকম সিন্ডিকেট আর অশুভ ফাঁদে এই শিল্প দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে। যার কারণে প্রতিবছর ‘গরীবের হক’ ধরাশয়ী হচ্ছে বড় ব্যবসায়ীদের বড় বড় ফাঁদে। যদিও এসব অভিযোগ মানতে নারাজ ট্যানারির প্রতিনিধিরাসহ বড় ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, এবার সাধারণ লোকজন চামড়ার ভালো দাম পেয়েছেন। দু-এক জায়গায় কম দামে বিকিকিনি হলে সেটা চামড়ার ওপর নির্ভর করে হয়েছে।

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে চামড়াপট্টি এলাকার প্রবীণ এক ব্যবসায়ী জানান, এবার গুটিকয়েক চামড়া কিনেছেন। তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে সিন্ডিকেট না হলেও অন্তরের চাওয়া-পাওয়ায় মিল ছিল। এ কারণে চামড়ার দাম খুব বেশি উঠেনি। এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং খারাপ আচরণের কারণে বাইরের বড় বড় ব্যবসায়ী এবং ট্যানারির প্রতিনিধিরা এই এলাকায় আসতে পারেন না। এটার প্রভাব পড়েছে চামড়ার দামে। 

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, চামড়া শিল্পে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা নিজেরাও সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে থাকেন। চামড়া কিনে ট্যানারি মালিকদের দেন। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন ট্যানারি মালিকদের কাছে এখন তাদের অনেকেই জিম্মি। বিগত কয়েক বছর ধরে ন্যায্য দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর ১৫-২০ জন ফড়িয়া ও অর্ধশত মৌসুমী ব্যবসায়ী এবং হাতেগোনা ৬-১০ জন ব্যবসায়ী চামড়া কিনলেও এ বছর বেশির ভাগকেই চামড়া কেনা-বেচায় দেখা যায়নি। সবমিলিয়ে তিন থেকে চারজন ছাড়া চামড়া কেনার মতো বড় কোনো ব্যবসায়ী ছিল না এ এলাকায়। অথচ এক সময় এই এলাকাতে শতাধিকের বেশি চামড়ার গুদাম ছিল। রংপুরের বাইরের আড়তদারদের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। চামড়া ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হাজীপাড়া চামড়া ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি এবং জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি। এসব এখন ইতিহাস।

দিন দিন গুদাম বন্ধের সঙ্গে চামড়া বিমুখ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে এখানে। আগের মতো চামড়া ব্যবসার রমরমা দিন না থাকায় সমিতিও বিলুপ্ত হয়েছে। চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন অটোবাইক ও রিকশার দোকান। কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন অটোরিকশা তৈরির কারখানা। এ কারণে চামড়াপট্টিতে এখন চামড়া নিয়ে নেই মাতামাতি করে না। শুধুমাত্র ঈদের সময়ে চামড়া কেনাবেচা হলেও সেখানে 'সিন্ডিকেটের অশুভ ছায়া' কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা তুলতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চামড়ার ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। আবার অনেকে চামড়া ব্যবসায় ঋণ না পেয়ে পুঁজির অভাবে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন যারা বাপ-দাদার এই ব্যবসা ধরে আছেন, তারা হাতে গোনা কয়েকজন। 

চমড়া ব্যবসায়ী শামছুল হক বলেন, সিন্ডিকেট করে কি লাভ? এমনিতেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ট্যানারি ছাড়া স্থানীয়ভাবে চামড়া সংরক্ষণের বিকল্প কোনো উপায় নেই। এখন আমদানিও কম। লবণের দাম তো বেড়েই চলেছে। এত কিছুর মাঝেও ট্যানারি মালিকেরা সরকারের কাছ থেকে ঋণ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছি। আমাদের ঋণ দেওয়া হয় না। অথচ ট্যানারি মালিকেরা চামড়া ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে। 

রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল লতিফ খান বলেন, চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে, এ নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই। তার মধ্যে আর্থিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের প্রায় দুই শতাধিত ট্যানারির মধ্যে এখন মাত্র ২০টি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারী করতে চাইছেন না। সব মিলিয়ে ঈদের তিন দিনে ১৫ হাজারের মতো চামড়ার আমদানি হয়েছে।

ভালো দাম না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বর্তমানে সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউই ভালো দাম পাচ্ছেন না। এমনিতে দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংক ঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।

এদিকে রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের অতিরিক্ত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জোবাইদুল কবীর জানান, এবার জেলায় গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া মিলে আনুমানিক ২ লাখ ৫০১টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। আর পুরো রংপুর বিভাগে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৩টি গরু-মহিষ ও ৬ লাখ ৭ হাজার ৮০৩টি ছাগল-ভেড়াসহ মোট ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৯৬টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। স্থানীয় মৌসুমী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা চামড়া কিনে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বা আড়তে পৌঁছে দেন। আড়তগুলো এসব চামড়া লবণজাত করে সংরক্ষণের ১৫ দিন থেকে এক মাসের মধ্যে ট্যানারি মালিকদের কাছে বা বিভিন্ন চামড়ার হাটে বিক্রি করে দেন।

তবে বিসিক রংপুর জেলা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) শামীম হোসেন বলছেন, জেলায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৩২০টি গবাদিপশু কোরবানি করা হয়েছে। এর মধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ব্যবসায়ী ও আড়তগুলোতে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ঈদের পর সাত দিন স্থানীয় চামড়া ঢাকায় নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা লবণজাতের মাধ্যমে চামড়া সংরক্ষণ করছেন। এবার কোথাও চামড়া অবিক্রিত থাকায় নষ্ট হয়েছে এমন খবর পাইনি।

আরআই